সেলাই মেশিনে সাফল্য
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
২০০৩ সালের কথা। স্বামী মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা বেতনের চাকরি করেন। সংসারের আয় বাড়াতে হবে। এমন তাড়না থেকে ওই বছরই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণে প্রথম স্থান অর্জন করে পান একটি সেলাই মেশিন। পারবেন, নাকি পারবেন না, এমন উৎকণ্ঠা আর শঙ্কা নিয়ে একটি সেলাই মেশিন নিয়েই শুরু করেন কাজ। ক্রমেই বাড়তে থাকে কাজের ব্যাপ্তি। ১৩ বছর পর এখন সফল নারী উদ্যোক্তা তিনি। তাঁর নাম আইনুন্নাহার। দীর্ঘ ১৩ বছরে অর্জনের ঝুলিতে জমা হয়েছে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। গত বছরের ১ নভেম্বর নারী কোটায় পেয়েছেন জাতীয় যুব পুরস্কার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সফল ও অনুকরণীয় নারী উদ্যোক্তা হিসেবে।
আইনুন্নাহারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৩ সালে ময়মনসিংহ শহরের একটা ভাড়া বাড়িতে যখন সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন, তখন পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীদের পোশাক তৈরি করে দিতেন। উপার্জন কেমন হবে, তা নিয়ে ছিল না কোনো চাহিদা। চিন্তা ছিল একটাই—সফল হতেই হবে। কাজের শেষে গ্রাহকেরা যা দিতেন, তাতেই সন্তুষ্ট হতেন। কাজের গুণে দ্রুতই নিজের ও আশপাশের পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে আইনুন্নাহারের কাজের কথা। ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন এলাকার নারীরা নিজের পোশাক বানাতে তাঁর কাছে আসতে শুরু করেন। বাড়তে থাকে কাজের ফরমাশ ও ব্যাপ্তি।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একা কাজ করে কুলাতে পারছিলেন না। আইনুন্নাহার কর্মী নিয়োগ না নিয়ে ২০ জন নারীকে নিজের বাড়িতেই প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিন মাসের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ শেষে পাঁচজনকে নিয়োগ দেন নিজের উদ্যোগে। ওই পাঁচজনকে নিয়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি শুরু হয়। ক্রমে বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। নারী ও শিশুদের জন্য পোশাক তৈরি করে প্রথমে ময়মনসিংহের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করতে শুরু করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পোশাক তৈরির কাজ পেয়ে যান। বেড়ে যায় তাঁর কাজ ও কর্মীর সংখ্যাও।
ময়মনসিংহের আসপাডা পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক আবদুর রশিদ একদিন আইনুন্নাহারের কাজ দেখে মুগ্ধ হন। সেটা ২০০৯ সাল। আসপাডা থেকে আইনুন্নাহার ঋণ নেন ৫০ হাজার টাকা। ওই সময় তিনি মন দেন দক্ষ কর্মী তৈরিতে। আয়োজন করেন প্রশিক্ষণের। প্রতিবছর চলতে থাকে চারটি করে ব্যাচের প্রশিক্ষণ। প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে নারী বিনা মূল্যে সেলাই ও বুটিকের কাজের প্রশিক্ষণ নেন।
২০১৩ সালে নারী উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধন নিয়ে আইনুন্নাহার প্রতিষ্ঠা করেন তৃণমূল নারী উন্নয়ন সমিতি। বর্তমানে এই সমিতির মাধ্যমে নিয়মিত চলে নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিবছর বের হয়ে আসছেন দক্ষ কর্মী। তাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়েছেন।
আইনুন্নাহারের রয়েছে তৃণমূল কারুপণ্য নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে তৈরি হয় ব্লকপ্রিন্ট ও বুটিকের পোশাক। দেড় বছর ধরে নিজের প্রতিষ্ঠানে তৈরি করছেন পাটের ব্যাগ ও অফিস ফাইল। ঢাকার রাপা প্লাজায় জয়িতাতেও ছিল তাঁর পোশাক বিক্রির জায়গা। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ময়মনসিংহ শহরের ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চালু করেছেন তৃণমূল কারুপণ্য দোকান।
দেশের বিভিন্ন মেলায় উদ্যোক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। দেশের বাইরে ভারতে দুবার, নেপালে একবার মেলায় স্টল নিয়েছে আইনুন্নাহারের তৃণমূল কারুপণ্য। সম্প্রতি চীনের একটি মেলায় অংশ নেয় এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে আইনুন্নাহারের অধীনে কাজ করছেন ১৬০ জন নারী ও পুরুষ।
আইনুন্নাহার বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমার কাজের সেরা স্বীকৃতি ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর নারী জাতীয় যুব পুরস্কার পাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পদক নেওয়া আমার জীবনে স্মরণীয় এক ঘটনা।’ কাজের ব্যাপারে স্বামী খোন্দকার ফারুক আহমেদের কাছ থেকে সব সময় সহযোগিতা পেয়েছেন। বললেন, ‘কাজের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অকৃত্রিম বন্ধু ও সহযোগীর ভূমিকায় থেকেছেন আমার স্বামী। তাঁর সহযোগিতা না পেলে এত দূর আসতে পারতাম কি না, সন্দেহ।’
২০১০ সালে সফল উদ্যোক্তা হিসেবেও আইনুন্নাহার পুরস্কার পেয়েছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে। ২০১৩ সালে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলা ও ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে ‘জয়িতা’ পুরস্কার ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কারের স্বীকৃতি। নারীদের দক্ষ কর্মী ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নারী উন্নয়ন ফোরাম। বর্তমানে এটির নিবন্ধন-প্রক্রিয়া চলছে।
আইনুন্নাহার বলেন, ‘পড়াশোনা শেষে ইচ্ছা ছিল চাকরি না করে নিজে কিছু করব। পাশাপাশি আমাদের সমাজের নারীদের কর্মী হিসেবে স্বাবলম্বী করা যায়, এমন ভাবনা ছিল। সেই ভাবনা নিয়ে আস্তে আস্তে আমি এগিয়েছি। প্রয়োজনই মানুষকে অনেক কিছু করতে সাহসী করে।’ সেই সাহস থেকেই আজ একজন সফল উদ্যোক্তা আইনুন্নাহার।