উদ্যোক্তাদের প্রতি রিচার্ড ব্র্যানসন
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছাত্র সমাজকে টার্গেট করে ‘স্টুডেন্ট’ নামক ম্যাগাজিন বের করেছিলেন রিচার্ড ব্র্যানসন, যার প্রথম ৫০ হাজার কপি শুধুমাত্র প্রচারের জন্য বিনামূল্যে বিতরণ করেছিলেন! যদিও বিজ্ঞাপন বাবদ ওঠা ৮ হাজার ডলারের কল্যাণে ওই খরচ পুষে যায়।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নিজের সাহসী এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ, কোনোকিছু শেখার আর কোনোকিছুর প্রতি লেগে থাকার আগ্রহ তাকে করে তোলে পৃথিবীর সেরা উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০১৬ সালে ফোর্বসে উল্লেখিত পৃথিবীর সেরা ৫০০ বিলিয়নিয়ারের মধ্যে যার ব্র্যানসনের অবস্থান ২৮৬তম এবং ব্রিটেনে অষ্টম। নিজের কোম্পানি ‘ভার্জিন’-এর অধীনে ৪৫০টি ছোট-বড় কোম্পানিকে পরিচালনা করা এই ব্যবসায়ীর মোট আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এই প্রতিবেদনে থাকছে নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য রিচার্ড ব্র্যানসনের পাঁচ পরামর্শ।
১. শুরুটাই যেকোনো কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনি যদি একটি কাজ শুরুই না করেন, তাহলে কখনোই কাজটাকে কিভাবে আরো বেশি অগ্রসর করা যাবে, সেই দিকে মনোযোগী হতে পারবেন না।
রিচার্ড ব্র্যানসন মনে করেন, তিনি এই বিশাল সাফল্য কখনোই অর্জন করতে পারতেন না, যদি মাত্র ১৬ বছর বয়সে ‘স্টুডেন্ট’ ম্যাগাজিন বের না করতেন। তার মতে, ‘যদি আপনি শুরু না করেই যাত্রাপথের শেষটা কী হবে সে দিকে বেশি মনোযোগী হন, যদি পথে আসন্ন বিপদ, সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন, তাহলে কখনোই সফলতা অর্জন করতে পারবেন না। কোনো কাজে অগ্রসর হতে গেলে হয়তো অসংখ্যবার হোঁচট খাবেন, বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হবেন, ভুল করবেন। আর ব্যবসায় ভুল হবেই।’ তিনি বলেন, ‘One thing is certain in business, you and everyone around you will make mistakes.’ কিন্তু যেখানে ভুল আছে, সমস্যা আছে, সেখানে ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। রয়েছে সমস্যাগুলোর সমাধান। আর মাত্র কোনো একটা কাজ শুরু করলেই আপনি সমস্যার সমাধানগুলোকে চিহ্নিত করতে পারবেন এবং ভুলগুলোকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
২. সুযোগগুলোকে কাজে লাগান, উদ্যোগটা নিজে নিন এবং কাজ করুন ভিন্নভাবে। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এগুলোই প্রধান ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে।
বিশেষ প্রয়োজনে পুয়ের্তোরিকোয় যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরে পৌঁছে ব্র্যানসন দেখলেন ফ্লাইট বাতিল। যাত্রীরা এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। সবারই গন্তব্যে পৌঁছা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো কিছু একটা করতে হবে। তিনি খোঁজ খবর নিয়ে দু’হাজার পাউন্ডে একটি বিমান ভাড়া করলেন এবং হিসেব করে দেখলেন ৩৯ পাউন্ড করে প্রত্যেক যাত্রীর ভাগে পড়ে।
তিনি নিজের কোম্পানি ভার্জিনের নাম অনুকরণে ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজ’ নাম দিয়ে একটি ব্লাকবোর্ডে লিখে দিলেন ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজে পুয়ের্তোরিকোয় যাওয়ার জন্য জনপ্রতি ভাড়া ৩৯ পাউন্ড’। আর এভাবেই তার মাথায় ভার্জিন এয়ারওয়েজের ধারণাটি আসে। পরবর্তীতে পুরোপুরি ব্যবসায়ীক ভিত্তিতে ভার্জিন ব্লু, ভার্জিন এক্সপ্রেস, ভার্জিন নাইজেরিয়াসহ পৃথিবীব্যাপী তার ত্রিশের অধিক বিমান উড়ে যায়! এমনকি তিনি মহাশূন্যে বাণিজ্যিকভাবে ভ্রমণের জন্য ‘ভার্জিন গ্যালাকটিক’ নামের সুবিধাও বাজারে ছাড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
রিচার্ড ব্র্যানসন সেদিনই প্রথম বিমান ভাড়া করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘যদি সেদিন সেই যাত্রীদের দুর্ভোগের সুযোগ কাজে লাগিয়ে উদ্যোগটা না নিতেন, যদি সবার চেয়ে আলাদা হয়ে ভিন্ন পদক্ষেপটা না নিতেন, তাহলে এই বিলিয়ন ডলারের এয়ারওয়েজ ব্যবসা কখনোই শুরু করা সম্ভব হতো না।’ তার মতে, লক্ষ্য অর্জনের জন্য, সফল হওয়ার জন্য উদ্যোগটা আগে নেওয়া প্রয়োজন। ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভিন্ন কিছু করার ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
৩. লক্ষ্য স্থির করুন। জীবনের প্রতি, নিজের কাজের প্রতি ইতিবাচক হোন। সুখে থাকার চেষ্টা করুন এবং এগিয়ে যান।
সফলতা অর্জনের জন্য প্রথমেই আপনাকে ‘কী করার মধ্য দিয়ে সফল হতে চান’ সেই লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আপনি যদি না জানেন আপনি কী করতে যাচ্ছেন, কেন করতে যাচ্ছেন, তাহলে কখনোই একটি কাজে অগ্রসর হতে পারবেন না। প্রত্যেকটা কাজে অগ্রসর হওয়ার জন্য ওই কাজের প্রতি অবশ্যই ইতিবাচক ধারণা রাখা প্রয়োজন। আপনি যত বেশি ইতিবাচক হবেন। যত বেশি ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে নিয়ে চিন্তা করবেন। সামনের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা তত বেশি সহজ হয়ে যাবে।
সুখী থাকার চেষ্টা করুন। যে কাজটাতে আপনি আনন্দ পান, যে কাজ আপনার সুখ নষ্ট করে না, সেগুলোই বেশি বেশি করুন। যত ছোটই হোক না কেন, সেগুলোই আপনাকে সফল করবে। সুখ এবং ব্যবসায়ীক সাফল্যকে সামঞ্জস্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘Happiness is the secret ingredient for successful businesses. If you have a happy company, it will be invincible.’
৪. সমস্যাগুলোকে বাড়তে না দিয়ে শুরুতেই মোকাবেলা করুন। সহকর্মীদের সাথে সদয় এবং সময় উপযোগী আচরণ করুন। প্রয়োজনে কঠোর হোন। কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন করবেন না।
স্টুডেন্ট ম্যাগাজিনটি তখন ভালোই সাড়া ফেলেছে। ব্র্যানসন তার কোম্পানিটিকে পুরনো বেজমেন্ট থেকে ভাড়া বাড়িতে স্থানান্তর করেন। এতে সহযোগী নিক কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়। একদিন ব্র্যানসন অফিসে এসে দেখেন ডেস্কের উপর পড়ে থাকা মেমোতে লেখা, স্টুডেটের প্রকাশকের পদ থেকে তারা ব্র্যানসনকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে তারাই এটি পরিচালনা করবে। ব্র্যানসন কিছুটা মর্মাহত হন। কেননা এ ধরনের সমস্যা এই প্রথম। তবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তিনি ভুলে করেন নি। বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি নিককে ব্যবসা থেকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব টিকে ছিল।
মেইল অর্ডারের মাধ্যমে তখন ম্যাগাজিন ব্যবসা তুঙ্গে। সব কিছু সামলাতে ব্র্যানসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তখন ব্র্যানসন আবার নিককে ডাকলেন। কেননা এই ব্যাপারগুলো সামাল দেয়ার ব্যাপারে নিক ছিল সিদ্ধহস্ত। ব্র্যানসন নিককে মেইল অর্ডারে পাওয়া লাভের ৪০ শতাংশ দিয়ে দিলেন। এর সাথে সাথে ব্র্যানসন এবং নিকের সম্পর্ক আরো বেশি অটুট হলো যা পরবর্তীতে ব্যবসায়ীক কাজগুলোতে ভালোই প্রভাব বিস্তার করেছে।
রিচার্ড ব্র্যানসন মনে করেন, সেই সময়ে নিককে ব্যবসা থেকে অব্যাহতির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তটাই তিনি নিয়েছিলেন। নয়তো সমস্যাগুলোকে চলতে দিলে আরো বেশি সমস্যা তৈরি হতো, যা হয়তো এক সময় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হতো। আর পরবর্তীতে নিকের সাথে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখে আবার অধিক মুনাফা দিয়ে ব্যবসায় ফিরিয়ে এনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘There is no magic formula for great company culture. The key is just to treat your staff how you would like to be treated.’
৫. জীবনকে উপভোগ করুন পুরোদমে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন এবং বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজগুলোতে নিজেকে সপে দিন।
ব্র্যানসন ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে যতটুকু জনপ্রিয়, তেমনি জনপ্রিয় তার বিভিন্ন ধরনের অভিযানের জন্য। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেও তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মাত্র চার বছর বয়সে ১০ শিলিং এর বাজিতে গ্রীষ্মের ছুটিতে সাঁতার শিখে দেখানো, বেলুনে চড়ে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া, বিপজ্জনক ফ্লাইং মেশিনে ওড়া (পরবর্তীতে যেটাতে উড়ে তার প্রস্তুতকারক মারা গিয়েছিল), সস্তায় আটলান্টিকের এপার ওপার যাত্রী পারাপার করাসহ নানান ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেই সাথে চ্যালেঞ্জগুলোকে বাস্তবায়িত করতে দুঃসাহসিক অনেক কাজ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে চ্যালেঞ্জ দুই ধরনের। এক হচ্ছে যে কাজটি করছি সেটা সর্বোত্তমভাবে করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঝুঁকি নেয়ার মাধ্যমে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অর্জন।’
আনন্দ করা, বিভিন্ন অভিযানে অংশগ্রহণ করা, চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করে তার বাস্তবায়নে কাজ করার মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করার ব্যাপারে তিনি উৎসাহ দিয়েছেন।