উদ্যোক্তার দুঃখ ঘোচাবে ওয়ান স্টপ সার্ভিস
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায়ীদের আফসোস ছিল কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেবা না থাকার। সরকারও বিনিয়োগের জন্য কাতর; নামকাওয়াস্তে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার গড়ে তুলেছিল বিলুপ্ত বিনিয়োগ বোর্ডের দপ্তরে। কিন্তু সেখানে সেবা বলতে কিছুই ছিল না। বিনিয়োগ বোর্ড থেকে বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার কাছে ব্যবসায়ীদের সেবা দেওয়ার সুপারিশ পাঠানো হলেও তা আমলে নিত না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো। ফলে ব্যবসায়ীরা হতাশা প্রকাশ করে ওই সেন্টারটিকে ‘ওয়ান স্টপ ফুলস্টপ’ নামে ডাকত। অর্থাৎ ওই ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে ফাইল যাওয়া মানেই ছিল কোনো দিনই আর কোনো সেবার অনুমোদন না পাওয়া। সে অবস্থার পরিবর্তন করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সত্যিকার অর্থেই ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেবা নিশ্চিত করতে আজ সোমবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উঠছে পৃথক আইনের খসড়া।
‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন, ২০১৭’ নামের নতুন এই আইনের আওতায় বিনিয়োগকারীরা প্রাথমিকভাবে পাবেন গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি সেবা, পরে সেবার সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বেজা, বিডা, বেপজা ও হাইটেক কর্তৃপক্ষ শুরুতে এই আইন কার্যকর করবে। পরে পর্যায়ক্রমে সরকারের অন্য সব সংস্থার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে।
সরকার ও ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, আইনটি কার্যকর হলে দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ আরো সহজ হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের অনেক দিন ধরেই দাবি ছিল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত পরিবেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেবা নিশ্চিত করার। দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এটি জরুরি। দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণে আমরা আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি। এটি কার্যকর হলে ব্যবসার পরিবেশ সহজ হবে এবং সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ’
পবন চৌধুরী বলেন, সরকারের কোনো কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি এসব সেবা দিতে অক্ষম হন, কোনো বিনিয়োগকারী যদি অভিযোগ করেন এবং সেটি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে আইনে।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘আইনটি সঠিকভাবে কার্যকর হলে তা বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করবে। বাংলাদেশে অনেক আইন ও নীতিমালা রয়েছে, যা সঠিকভাবে কার্যকর করা হয় না। আমরা চাই, সরকার যেন আইনটি কার্যকরে কঠোর ভূমিকা পালন করে। ’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সেবা, অনাপত্তি ও লাইসেন্স দিয়ে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে। দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠিত বেজা ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বিভিন্ন বিনিয়োগ সেমিনার ও রোড শো করেছে। সেখানেও জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা কার্যকর ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেবা নিশ্চিত করতে তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইন ও বিধি দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিস দ্রুততরভাবে দেওয়ার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো মন্ত্রণালয় বা দপ্তর দ্রুত সেবা নিশ্চিত না করলে তার প্রতিকারের জন্যও কোনো আইন নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে সরকার নতুন এই আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, চীনের এসংক্রান্ত আইন পর্যালোচনা করে নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ভিন্ন কোনো আইনের অধীনে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা দপ্তর বিভিন্ন সেবা, প্রণোদনা, লাইসেন্স, পারমিট দিলেও এই আইনের বিধানকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। খসড়া আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সেবা, সুবিধা, প্রণোদনা প্রদানকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় ওয়ান স্টপ সার্ভিস কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী নিজ সংস্থার উপযুক্ত কর্মকর্তাকে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করবে, যিনি এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কেন্দ্রীয় ওয়ান স্টপ সার্ভিস কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন এবং তিনি নিজ সংস্থার পক্ষে সংশ্লিষ্ট কার্য সম্পাদন করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবেন। ’
খসড়া আইনের ৪(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন উদ্যোক্তা বা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ওয়ান স্টপ সার্ভিসের সুবিধা গ্রহণ করতে চাইলে ওয়ান স্টপ সার্ভিস কর্তৃপক্ষের নিকট নির্ধারিত পদ্ধতিতে আবেদন করবেন এবং তা বিধি দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ও পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করা হবে। ’ কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীনে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে এবং সেই কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো আবেদন নিষ্পত্তি করা না গেলে, তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে খসড়ায় বলা হয়েছে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় প্রাথমিকভাবে যে ১৬টি সেবা নিশ্চিত করা হবে তার মধ্যে রয়েছে—প্রকল্পের ছাড়পত্র, ওয়ার্ক পারমিট, ভিসার জন্য সুপারিশ, আমদানির অনুমতিপত্র, রপ্তানির অনুমতিপত্র, যা এখন বেজা কার্যালয় থেকে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়। এর বাইরে আগামী জুলাই মাসের মধ্যে বেজা কার্যালয় থেকে আরো পাঁচটি সেবা দেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে—ভবনের নকশা অনুমোদন, বিদ্যুৎ সংযোগ, বিদেশি ঋণ নেওয়া, স্থানীয়ভাবে পণ্য বিক্রির অনুমতিপত্র ও স্থানীয়ভাবে ক্রয় অনুমতিপত্র।
আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আরো ছয়টি সেবা নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে থাকছে—পরিবেশ ছাড়পত্র, কম্পানি নিবন্ধন, অফশোর ব্যাংকিং, সাব-কন্ট্রাক্ট, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার— টিআইএন, অগ্নিনির্বাপক ছাড়পত্র ও ব্রয়লার ছাড়পত্র।