ছোট ব্যবসার বড় ব্যবস্থাপনা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
দুনিয়াজুড়ে ছোট বা মাঝারী প্রতিষ্ঠান উৎপাদন এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে বিরাট ভুমিকা পালন করে আসছে। শুধু বড় শিল্পের সহযোগী হিসেবে নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সার্বিক পুঁজির যোগান, লোকবল নিয়োগ, মুল্য সংযোজন এসব ক্ষেত্রে বড় অর্থনীতিতে—যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স,জাপান, সামষ্টিকভাবে মূল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে চালিকা শক্তি হিসেবে ভুমিকা রেখে আসছে। আর এই ভুমিকা পালনের পেছনে রয়েছে এদের অল্প পুঁজির নির্ভরতার মধ্যে ব্যবসায়িক জ্ঞান, পুঁজি এবং কারিগরি জ্ঞানের উৎকর্ষতা, বাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সর্বশেষ ধারনা এবং ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠিন আধুনিক নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা ব্যবস্থার প্রয়োগ।
আমাদের দেশেও ছোট ব্যবসা আমাদের অর্থনীতেতে একই ভুমিকা পালন করে আসছে তবে কারিগরী জ্ঞান, আধুনিক ধ্যান ধারনার অভাবে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ছোট ব্যবসা কী
সাধারণত অল্প পুঁজি নিয়ে কোনো উদ্যোক্তা যখন ব্যাবসা বা উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করে এবং নিজে অথবা অল্প কিছু লোক নিয়োগ দিয়ে তা পরিচালনা করে—এইসব প্রচেষ্টাকেই ছোট ব্যবসা হিসেবে ধরা হয়।
কখনো আবার পুজির পরিমাপেও নির্ণয় করা হয়—যেমন ১০,০০০ থেকে ১০ লাখ বা ১ কোটি টাকা।
পুঁজি কী
লগ্নিযোগ্য এবং বিনীয়োগকৃত অর্থকেই সাদামাটাভাবে পুঁজি বলা যেতে পারে। এই পুঁজির সাধারণ বৈশিষ্টগুলো এরকম—নিজস্ব অর্থ, পারিবারিক ঋণ (আত্নীয়, বন্ধু), প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ– ব্যাংক, এনজিও বা কোনো লগ্নিকারি প্রতিষ্ঠান বা অংশীদারের বিনিয়োগ।
পুঁজি বা মূলধনের আর এক বৈশিষ্ট্য হলো—এটা হতে পারে ফিক্সড বা দীর্ঘমেয়াদী এবং চলতি বা স্বল্পমেয়াদি।
পুঁজির উৎস এবং যোগান
সাধারণভাবে একজন উদ্যোক্তা নিম্নলিখিতভাবে পুঁজির যোগান দেয়:
ক। নিজস্য জমাকৃত টাকা এবং আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে স্বল্প মেয়াদে ঋণ।
খ। ব্যাংক লোন বা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে (এনজিও ইত্যাদি) লোন।
গ। অংশিদার গ্রহণ।
উপরেল্লিখিত তিন ধরনের পুঁজির বৈশিষ্ট্যও তিন রকম, যা প্রতিটি উদ্যোক্তার সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন।
১। নিজস্ব বা স্বজনের কাছ থেকে নেয়া পুঁজির উপর কোনো সুদ বা চার্জ নাই, ‘ফ্রি মানি’। তবে এই টাকাটা ব্যংকে জমা রাখলে যে মুনাফা পাওয়া যেত সেটা হিসেবে রাখা দরকার।
২। যেকোনো লোনের উপর মাসিক হারে সুদ থাকে, থাকে সঠিক সময়ে না দিতে পারার উপর পেনাল্টি, ফাইন এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ। এখানে লোনের পরিমান এবং তার থেকে আয়টা যদি সুদ থেকে বেশী না হয় তাহলে ব্যবসার লাভ না হয়ে ক্ষতিই হবে মাসের শেষে।
৩। অংশিদার যেমন ফ্রি টাকা বা পুঁজি আনে তেমনি আনে তার অভিজ্ঞতা। কিন্তু পাশাপাশি সঙ্গে থাকে তার নিজস্ব ভাবনা এবং উচ্চাশা। আর শুরুতেই যদি অংশিদারের কর্মকাণ্ডের গণ্ডি এবং পরিধি বিস্তারিতভাবে আলেচিত হয়ে মতৈক্য না হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তিতে অংশিদার নানা সমস্যা তৈরি করে এবং ব্যক্তিগত মনমালিন্য থেকে তা ব্যবসায়ীক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৪। ব্যক্তিমালিকানা বা পারিবারিক ব্যবসা
যেসব উদ্যোগ ব্যক্তিনামে বা পারিবারিক নামে স্থানীয় পৌরপ্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করে। এখানে উদ্যোক্তা একজন ব্যক্তি হিসেবে ব্যবসার যাবতীয় আইনি এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজে দায়বদ্ধ থাকেন। এইসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যপারে আইনের বাধ্যবাধকতা কম, এর আয় একজন ব্যক্তির আয় ব্যয় হিসেবে বছর শেষে সরকারের কাছে সাধারণ নিয়ম মাফিক ট্যাক্সের জন্য রিটার্ন দিতে হয়।
৫। অংশিদারি বা পার্টনারশিপ ব্যবস্যা
ব্যক্তিমালিকানার মতোই আইনি কাঠামো, শুধু এখানে একের অধিক মালিকানাসত্ব থাকে। এখানে অংশিদার তার বিনীয়োগ বা কাজের দায়িত্বভেদে লাভ-লোকশানের হিসেবে শরিক হন। এই শরিক হওয়ার যায়গাগুলো শুরু থেকেই পরিস্কারভাবে লিখিত চুক্তি আকারে থাকা খুব দরকার, আর যেখানে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখ থাকা প্রয়োজন:
ক। অংশিদারের পুঁজির পরিমান – (যেমন – ৫০,০০০ টাকা
খ। ব্যবসায় তার অংশের পরিমান – ৩০% (লাভ অথবা লোকসান)
গ। তার দায়িত্ব– ফুলটাইম হিসেবে বিক্রয়, পাওনাদার, মজুদ মালামাল এবং বিক্রয়ের যাবতীয় হিসেব পরিচালনা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইত্যাদি।
ঘ। মাসিক পারিশ্রমিক – নাই, অথবা মাসের শেষে বেতন – ১০,০০০ টাকা।
ঙ। লভ্যাংশ – ষান্মাসিক/ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রত্যাশিত মুনাফার অংশ নগদ উত্তলোন করতে পারবেন যা বাৎসরিক হিসেব শেষে মিলেয়ে নেয়া যাবে এবং নগদ প্রদান করা হবে। যদি নগদ দেয়া না হয় বা তুলে নেয়া না হয় তাহলে সেই টাকার উপর কোন সুদ বা অন্য কোন সুবিধা আরোপ হবে না। তবে লভ্যাং যদি মুলধন হিসেবে ব্যবসায় খাটা হয় সেক্ষেত্রে সেটা পরিস্কারভাবে উল্লেখ করতে হবে অন্য শরিকের সাথে। এই ব্যপারটা আবার পুর্বল্লিখিতভাবেও থাকতে পারে যে মোট মুনাফার ৫০% শুধু তোলা যাবে বাকীটা ব্যবসায় খাটানো হবে ।
চ। নগদ উত্তোলন বা চলতি হিসাব – মাসিক বেতন বা লভ্যাংশের টাকার চলতি হিসাব থাকবে যা থেকে নগদভাবে টাকা ইচ্ছেমত তুলতে পারবে তবে জমার অতিরিক্ত কখনই তুলতে পারবে না। যদি ব্যবসা থেকে সাময়িক হাওলাদ করতে হয় সেটার পরিমান, সময় হয় আগেভাগে উল্লিখিত – যা সবার জন্য প্রযোজ্য অথবা অন্য শরীকের সংগে মতৈক্যের ভিত্তিতে হতে হবে। মনে রাখতে হবে নগদ উত্তোলন এবং চলতি হিসেব ঠিকভাবে সবার জন্য একই রকম নিয়মে চালিত না হওয়ার মধ্যে লুক্কায়িত থাকে অসন্তোষের বীজ এবং অবশেষে ব্যবসার সর্বনাশ।
ছ। হিসাব সংরক্ষণ – সবচ্ছতা এবং সময়মত ও সঠিক হিসেব রাখাটা অংশিদারী ব্যবসায় আরো জরুরী। এই ব্যাপারে ছোট পুজির যেমন থাকেনা অভিজ্ঞতা তেমনি থাকে এক ধরনের উদাসীনতা। যা পরবর্তিতে ব্যবসায়িক সংকট তৈরি করে শুধু অংশিদারের মধ্যেই নয় অর্থনৈতিক সমস্যাও সৃষ্টি করে ব্যবসার সার্বিক কার্যক্রমের সঠিক বর্ননা না থাকার জন্য।
শেষ কথা
মনে রাখতে হবে ব্যবসা পরিচালনা জটিল ব্যাপার, কেউ সহজেই এর থেকে ভালো কিছু আশা করলে ভুল হবে কেননা এখানে অনেক উপাদান নিহিত থাকে সেটা ব্যবসা পরিচালনা হোক আর বাজার ব্যবস্থাপনাই হোক, আর এসব কিছুকে উপলব্ধি করলেই কেবল নিয়ম মাফিক তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একজন সত্যিকারের উদ্যোক্তাই কেবল সব সময় চাইবে তার কষ্টের পুঁজিকে সব সময় রক্ষা করতে সব রকম চেষ্টা দিয়ে কেননা এর সংগে শুধু তার উচ্চাকাঙ্খাই জড়িত নয় আছে তার ভবিষ্যৎ এবং ভালভাবে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি।