উদ্যোক্তাবৃত্তি শুরু হোক স্কুল থেকেই
- অরবিন্দ চিনচুরে
সম্পদ সৃষ্টির সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্রের নাম স্টার্টআপ, কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। ভারত আশা করছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারা পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। যদি সেটাই হতে চায়, তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে ভারতে ৩০০ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আর এই বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দরকার হবে ১০০ মিলিয়ন চাকরি। বর্তমানে ভারতে যে পরিমাণ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা দিয়ে এই স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে কাজ করতে পারে স্টার্টআপ। স্টার্টআপই পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশ ঘটাতে।
বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল স্টার্টআপসের দেশ হওয়ার জন্য ভারত বেশ আগে থেকেই যাত্রা শুরু করেছে। বর্তমানে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পর তৃতীয় বৃহত্তম প্রযুক্তি-পণ্যের স্টার্টআপে পরিণত হয়েছে। গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনারশিপ মনিটর বলছে, প্রায় কুড়ি শতাংশ ভারতীয় আগামী তিন বছরের মধ্যেই কোনো না কোনো ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করছে। এদের মধ্যে ১১ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই কালে ভারতের সামনে রয়েছে এক বিরাট সুযোগ। ভারত চাইলেই তার উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও শিক্ষাবীদদেরকে নিয়ে স্টার্টআপের মাধ্যমে একটি উন্নত জাতিতে পরিণত হতে পারে। এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই উদ্যোক্তাবিষয়ক নতুন নতুন সুযোগের সন্ধান করতে হবে। উদ্ভাবন করতে হবে নতুন নতুন আইডিয়ার। এবং অতি অবশ্যই কিছু প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে—যেমন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জানা, প্রযুক্তিনির্ভর আইডিয়া উদ্ভাবন করা, সময়পোযোগী পণ্য ও সেবা উদ্ভাবন করা ইত্যদি। এসবের মাধ্যমে আগামীর বিশ্বকে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
ইন্ডাস্ট্রি ফোর পয়েন্ট জিরো
নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ‘মাইক্রোপ্রসেসর’ ও ‘ইনটিগ্রেটেড চিপস’ এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ভারতের প্রযুক্তি শিল্প এই নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশে পরিণত হতে পারে। বর্তমানে ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আউটসোর্সিংয়ের দেশ। এই খাতে অন্তত ১০ মিলিয়ন পেশাজীবী কাজ করছেন।
এই সময়ে পুরো বিশ্বজুড়েই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব খুব চমৎকারভাবে বিকশিত হচ্ছে। উৎপাদনশীল শিল্পে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির কল্যাণে পণ্য ডিজাইন, পণ্য উৎপাদন, বিপণন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়া আমূল বদলে গেছে। এই যে সবকিছু ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, এই সবকিছুই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অংশ। প্রযুক্তি একদিকে যেমন উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে পণ্যের গুণগত মানও বাড়াচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে স্মার্ট সেন্সর, অটোমেশন, রোবট, আইওটি, ক্লাউড কম্পিউটিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, বিগ ডেটা ইত্যাদি নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে।
উদ্যোক্তাবিষয়ক শিক্ষা
একজন উদ্যোক্তার প্রস্তুতিমূলক যাত্রা শুরু হওয়া উচিত স্কুল থেকেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের, বিশেষ করে ভারতের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তাবৃত্তি শেখার যথাযথ পরিবেশ নেই। ইউরোপ-আমেরিকার চিত্র অবশ্য ভিন্ন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তা তৈরির ইকোসিস্টেম রয়েছে।
ভারতে এই মুহূর্তে উদ্যোক্তাদের জন্য ইকোসিম্টেম তৈরি করা বাঞ্চনীয়। যদি সত্যিকার অর্থেই বেশি বেশি সফল উদ্যোক্তা তৈরি করতে চান, তবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্যোক্তাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যেমন:
১. শিক্ষার্থীদেরকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেকোনো বিষয়ে পরীক্ষা করা, পর্যবেক্ষণ করা ও নেটওয়ার্ক তৈরি করার ব্যাপারে তাদের ভয় দূর করতে হবে। তাদেরকে ব্যর্থতার কষ্ট সহ্য করা শিখতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে, ব্যর্থতা উদ্ভাবনেরই একটা অংশ।
২. শিক্ষার্থীদেরকে সুর্নিদিষ্ট বিষয় ও সমস্যার ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে শেখাতে হবে। যেকোনো উদ্ভাবন ও সমস্যা সমাধানের স্বীকৃতি হিসেবে তাদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে।
৩. নতুন সমস্যা, নতুন উদ্ভাবন, নতুন আইডিয়াকে বাস্তবরূপদানে শিক্ষার্থীদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে।
৪. শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য হাতে-কলতে শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যাপ্ত গবেষণাগার তৈরি করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকল্প নিয়ে পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও গবেষণা করতে পারে। সৃজনশীল ও উদ্ভাবক শিক্ষার্থীদেরকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৫. এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করুন যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ভাবনী আইডিয়া দাখিল করতে পারবে, প্রকল্পের উন্নয়ন করতে পারবে এবং পরীক্ষামূলকভাবে তাদের প্রকল্প পরিচালনা করতে পারবে।
উদ্যোক্তা-সহায়ক ইকোসিস্টেম
উদ্যোক্তাদের জন্য ইনকিউবেশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতীয় সরকার অনেক প্রতিষ্ঠানকে তহবিল প্রদান করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক স্টার্টআপও যাত্রা শুরু করেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোক্তাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সুদক্ষ প্রযুক্তিবিদদের ধরে রাখা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একটি ‘গ্লোবাল সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এজন্য শিল্প-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় করা ছাড়া উপায় নেই। সারাবিশ্বে এখন এটাই করা হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমির মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছে।
এই গ্লোবাল সেন্টার অব এক্সিলেন্স উদ্যোক্তাদের পণ্য তৈরি, সমস্যা সমাধান, ব্যবসায়িক অগ্রগতির মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা করবে।
পরামর্শদাতা খুঁজুন
উদ্যোক্তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য পরামর্শদাতার প্রয়োজন হয়। ভারতীয় সমাজে এই বিষয়টি খুবই উপেক্ষিত। আলাদা আলাদা স্টার্টআপের জন্য আলাদা আলাদা পরামর্শদাতা দরকার। যেমন: গ্রাফিক ডিজাইন, ডোমেইন ইত্যাদি স্টার্টআপের ক্ষেত্রে নিয়মিত পরামর্শদাতা প্রয়োজন।
বলে রাখা প্রয়োজন, পরামর্শদাতারা বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন। সুতরাং যেকোনো স্টার্টআপকে ব্যবসায়িকভাবে সফল করতে হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হয়।
বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন
এই সময়ের মানুষদের বলা হচ্ছে বিশ্বনাগরিক। সুতরাং বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, সে বিষয়ে আপনাকে ধারনা রাখতে হবে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনাকে জানতে হবে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে। বিশ্বের অপরাপর দেশে উদ্যোক্তারা কীভাবে উদ্যোক্তা হচ্ছেন, সেসব জানলে নিজের ভেতর অনুপ্রেরণা তৈরি হয়। তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা দেখে শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। শুধু তাই নয়, সারা বিশ্বের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যায় আঞ্চলিক পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
গত এক দশক ধরে ভারতে উদ্যোক্তাবৃত্তির পরিবেশ ক্রমশ উন্নত হচ্ছে, এটা আশার কথা। এখন উদ্যোক্তাবৃত্তিকে ফোকাসে রেখে আমরা একটা উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। সেই শিক্ষাব্যবস্থা অসংখ্য ছেলেমেয়েকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলবে। শুধু তাই নয়, এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলবে যারা প্রযুক্তিখাতে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও উদ্যোগ নিয়ে এসে দেশটাকেই বদলে দেবে।
অরবিন্দ চিনচুরে : কিউল্যাব একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এবং ফ্লেম ইউনিভার্সিটির চেয়ার মেন্টর
সূত্র: দ্য হিন্দু
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম