পরিবহন গবেষণায় ৭ পুরস্কার বাংলাদেশের

পরিবহন গবেষণায় ৭ পুরস্কার বাংলাদেশের

  • নওরীন কেয়া

ভিনদেশে পড়তে এসে হঠাৎ বাংলাদেশি কারও সঙ্গে দেখা হলে এমনিই মন ভালো হয়ে যায়। প্রাণ খুলে মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ তো আর সব সময় মেলে না। তার ওপর গবেষকদের একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে যদি শতাধিক লাল-সবুজের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা হয়, আনন্দটা বাড়ে আরও। পরিবহন প্রকৌশল ও এ বিষয়ক গবেষণার সবচেয়ে বড় সম্মেলন, ট্রান্সপোর্টেশন রিসার্চ বোর্ডের ৯৭তম বার্ষিক সভায় অংশ নিয়েছিলাম আমি। নিজের একটা অর্জন তো আছেই, পাশাপাশি বাংলাদেশি অনেক গবেষকের প্রবন্ধ উপস্থাপন ও পুরস্কারপ্রাপ্তি মিলিয়ে দিনটা আমার বিশেষভাবে মনে থাকবে। সম্মেলন শেষে দেখলাম, ৭টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার এসেছে আমাদের হাতে।

প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপোর্টেশন রিসার্চ বোর্ড বা টিআরবি ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘পরিবহন’ বিষয়ে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। পরিবহন খাতে নিত্য নতুন গবেষণা, অভিনব প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রয়োগকে উৎসাহিত করাই টিআরবির এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য। ৭ থেকে ১১ জানুয়ারি বসেছিল এই বিশাল সম্মেলনের এবারের আসর। গবেষক, শিক্ষার্থীরা ছাড়াও সমস্ত বিশ্ব থেকে পরিবহন ও যোগাযোগ-সংক্রান্ত পেশায় যুক্ত পরিকল্পনাবিদ এবং বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রতিনিধিসহ প্রায় ১৩ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি ছিল পাঁচ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে। যেখানে এক শরও বেশি বাংলাদেশির দেখা পেলাম এ বছর। তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, গবেষণা বা শিক্ষকতা করছেন, কেউ কেউ বিখ্যাত কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের প্রাপ্ত পুরস্কারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিসেবে আমি প্রথমেই রাখব ‘২০১৭ সিইউটিসি (কাউন্সিল অব ইউনিভার্সিটি ট্রান্সপোর্টেশন) চার্লে ভি. উটান মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’কে। ইউনিভার্সিটি অব কানেটিকাট থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করা বাংলাদেশের ড. অন্বেষা এনাম এই পুরস্কার পেয়েছেন। পরিবহনের নীতি প্রণয়ন ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ড. অন্বেষা ২০০৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক শেষ করেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি বুয়েটে শিক্ষকতা করেছেন।

প্রতিবছর টিআরবির ‘রিসার্চ অ্যাডভাইজরি কমিটি’ চারটি প্রকল্পকে ‘সুইট সিক্সটিন’ অ্যাওয়ার্ড দেয়। এবার এই চারটি প্রকল্পের মধ্যে একটি একজন বাংলাদেশির—তিনি ড. মইনুল মাহদী। ড. মইনুল লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে গত বছর পিএইচডি সম্পন্ন করে একই প্রদেশের ট্রান্সপোর্টেশন রিসার্চ সেন্টারের ‘পেভমেন্ট রিসার্চ ম্যানেজার’ হিসেবে কর্মরত আছেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলো ‘ইউটিসি আউটস্ট্যান্ডিং স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’। কাউন্সিল অব ইউনিভার্সিটি ট্রান্সপোর্টেশন সেন্টারের বার্ষিক ভোজে সবার সামনে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। এই সম্মাননাও এবার ড. নূর হোসেন নামের একজন বাংলাদেশির হাতে এসেছে। তিনি গত বছর ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমা থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে এখন কলোরাডো প্রদেশে জিওক্যাল ইনক নামের একটি প্রতিষ্ঠানে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন।

প্রতিবছর ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ফেডারেল হাইওয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যৌথভাবে শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রবন্ধের ওপর প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। মহাসড়কে দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার জন্য জমা দিতে হয়। পুরস্কার পায় তিনটি। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশের দুই পিএইচডি শিক্ষার্থী মেজবাহ উদ্দিন ও ফাহিম আহমেদের গবেষণা প্রবন্ধ এবার সেরা তিনে জায়গা করে নিয়েছে। এ ছাড়া সিটি কলেজ অব নিউইয়র্কের স্নাতকোত্তরে পড়ুয়া শিক্ষার্থী সাবরিনা রহমানের গবেষণা প্রবন্ধ ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন’ বিভাগে সেরা নির্বাচিত হয়। ‘ট্রাভেল টাইম, স্পিড ও রিলায়েবিলিটি’ বিষয়ে সেরা নির্বাচিত হয় ড. মো. শাহাদাত ইকবাল এবং তাঁর সহকর্মীদের গবেষণা প্রবন্ধ। ড. ইকবাল গত বছর ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।

‘ফ্রেইট মডেলিং’ ক্যাটাগরিতে একটি পুরস্কার পেয়েছি আমি ও ড. সাবরীনা আনোয়ার। গোটা যুক্তরাষ্ট্রে ভারী যান ব্যবহার করে যেসব পণ্য পরিবহন করা হয়, সেসবের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি, কীভাবে এই পদ্ধতিটা আরও সহজ করা যায়।

প্রায় ৬ হাজার ২০০ গবেষণা প্রবন্ধ জমা পড়েছিল এবারের সম্মেলনে। প্রায় ৮০০টি সেশন, কর্মশালা এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরির কমিটির মিটিংয়ে গবেষণা প্রবন্ধগুলো উপস্থাপিত হয় এবং সেরাদের পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৩ সালে বুয়েট থেকে পুরকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করে আমি ২০১৫ সালে ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম উচ্চশিক্ষার জন্য। এই সম্মেলন বোধ হয় বিদেশে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। এতগুলো বিভাগে নিজ দেশের, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের নাম দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছি।

লেখক : ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় পিএইচডি করছেন

সূত্র: প্রথম আলো

Sharing is caring!

Leave a Comment