‘ভাসমান শিক্ষাতরী’তে আলোর দিশা

‘ভাসমান শিক্ষাতরী’তে আলোর দিশা

  • নিউজ ডেস্ক

হাওরবেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলার কিছু চরের চার পাশে থই থই পানি থাকে বছরের প্রায় ছয় থেকে আট মাস। তাই দূরবর্তী স্কুলগুলোতে যেতে পারে না শিশুরা। এমন বাস্তবতায় এসব এলাকায় ‘ভাসমান শিক্ষাতরী’র মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম চালাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানিবেষ্টিত গ্রামগুলোর মাঝামাঝি স্থানে ভাসমান একটি নৌকাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষাবঞ্চিত ওই সব শিশুর জন্য ব্র্যাক পরিচালিত ভাসমান শিক্ষাতরীগুলো এরই মধ্যে স্থানীয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। 1475293812-bhairab-pic-3

ব্র্যাকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশব্যাপী তারা ছয় শতাধিক শিক্ষাতরী পরিচালনা করছেন। এমন শিক্ষাতরীর প্রায় ১০০টি পরিচালিত হচ্ছে কিশোরগঞ্জে। এর মধ্যে ভৈরব-কুলিয়ারচরে পরিচালিত ছয়টি শিক্ষাতরীতে শিক্ষা নিচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।

ব্র্যাকের কর্মকর্তারা জানান, সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের আর্থিক সহায়তায় বেশ সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে এখানকার প্রাথমিক শিক্ষার ভাসমান স্কুল ‘ব্র্যাক শিক্ষাতরী’। এই শিক্ষাতরীতে দেশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে পড়ানো প্রচলিত সিলেবাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে চর্চা করানো হয় নাচ-গান, অভিনয়, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি। তাই শিক্ষাতরীর শিশুরা বিনোদন শিক্ষা গ্রহণ করছে বেশ আনন্দ ও আগ্রহ নিয়ে।

শিক্ষাতরীতে পড়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয় কিছু শিক্ষার্থীর কাছে। তারা নিজ নিজ শিক্ষাতরীর বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের বাগাইকান্দি চরের ব্র্যাক ভাসমান শিক্ষাতরীর শিক্ষার্থী জেসমিন ও রাহুল। ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের নয়াহাটি শিক্ষাতরীর চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রুবিনা ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাফায়েত। কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সুতী ইউনিয়নের ষোলরশি ও হাজারীনগর গ্রামের ভাসমান শিক্ষাতরীর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিলন মিয়া ও আয়েশা। তারা জানায়, শিক্ষাতরীতে পড়ে তারা খুব আনন্দ পায়। বইয়ের পড়ার বাইরে তারা নাচ-গান, অভিনয়, আবৃত্তি করতে পারছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভৈরবের গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের বাগাইকান্দি চরে, কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের নয়াহাটি গ্রামে, কুলিয়ারচরের ছয়সুতী ইউনিয়নের ষোলরশি ও হাজারীনগর গ্রামে ব্র্যাকের ছয়টি ভাসমান শিক্ষাতরী পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষাতরীতে ৩০ থেকে ৩৩ জন শিশু শিক্ষার্থীকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। তারা সেখানে পড়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। সম্পূর্ণ বিনা খরচে ওই সব শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতে পারছে। 1475293256-bhairab-pic-2

একজন নারী শিক্ষক সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘণ্টা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। শিক্ষাতরীর প্রতিদিনের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে বাগাইকান্দি শিক্ষাতরীর শিক্ষক ইয়াসমিন বেগম, নয়াহাটির রানু আক্তার এবং হাজারীনগরের লাভলী বেগম জানান, এখানে শিক্ষা গ্রহণ করে শিশু শিক্ষার্থীরা বেশ উৎফুল্ল। তারা নিয়মিত আসে এবং প্রতিদিনের বাড়ির কাজ করে আনে। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা পাওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীদের সময় কাটে একটি চমৎকার পারিবারিক আমেজে।

এদিকে ব্র্যাক পরিচালিত ভাসমান শিক্ষাতরীতে নিজেদের সন্তানের পড়াশোনার সুযোগ হওয়ায় সন্তুষ্ট অনেক অভিভাবক। বাগাইকান্দির অভিভাবক রোজিনা বেগম, আসমা খাতুন, আউয়াল মিয়া ও খুরশেদ খন্দকারের অভিমত, অন্যান্য এলাকায় দুটি করে ভাসমান শিক্ষাতরী পরিচালিত হলেও তাদের এখানে একটি। ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি না করাতে তাদের এলাকার বহু শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাঁদের দাবি, আরো একটি শিক্ষাতরীর কার্যক্রম অথবা চলমান শিক্ষাতরীটি দুই বেলা (দ্বিতীয় শিফ্ট) চালানোর। shikhar-alo

ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির ভৈরব শাখার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন জানান, শিক্ষাতরীগুলোতে ৩০ থেকে ৩৩ জন শিক্ষার্থীর বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। আর শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানো বা ডাবল শিফ্ট করতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি স্থানীয় এ চাহিদার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলেও জানিয়েছেন।

কুলিয়ারচরের হাজারীনগর গ্রামের ভাসমান শিক্ষাতরীর কার্যক্রম পরিদর্শনে আসা ব্র্যাক প্রধান কার্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. এমরান হোসাইন এ বিষয়ে কথা বলেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে। তিনি জানান, ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে ২০১০ সাল থেকে। আর হাওরাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে ভাসমান শিক্ষাতরীর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে ২০১১ সাল থেকে। ১০টি স্কুল পরিচালনার মাধ্যমে এ কার্যক্রমের সূচনা হয়। গত বছর এই ভাসমান শিক্ষাতরীর প্রথম ব্যাচের শিশু শিক্ষার্থীরা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়। ৭০ শতাংশ জিপিএ ফাইভসহ পসের হার শত ভাগ। সারা দেশের ৬০৭টি ভাসমান শিক্ষাতরীর মধ্যে কিশোরগঞ্জে ১০০টি এবং ভৈরব-কুলিয়ারচরে ছয়টি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।

ব্র্যাকের এ কর্মকর্তা জানান, যেসব এলাকা বছরের ছয় থেকে আট মাস পানি পরিবেষ্টিত থাকে, ওইসব অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষাদানে ব্র্যাক এই শিক্ষাতরী পরিচালনা করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে এমরান হোসাইন বলেন, “স্থানীয় চাহিদার বিষয়টি এরই মধ্যে আমরা জানতে পেরেছি। ব্র্যাকের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিষয়টি উত্থাপন করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তা ছাড়া ব্র্যাকের এ শিক্ষা কার্যক্রম কর্মসূচিটি যেহেতু কাতারের ‘রাণী’র মহানুভবতায় পরিচালিত হচ্ছে, সেহেতু উনাকেও বিষয়টি অবহিত করা হবে।”

সূত্র : এনটিভি অনলাইন। favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment