অভাব নয়, ব্যার্থতাকে বেশি ভয় পেতাম : জে কে রাওলিং
লিডারশিপ ডেস্ক: জে কে রাওলিং ১৯৬৫ সালের ৩১ জুলাই ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা তিনি।জন্মোর পর থেকে অভাবকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তবে তিনি কখনো অভাবকে ভয় পাননি – ভয় পেতেন ব্যর্থতাকে। একসময় সব ব্যর্থতাকে জয় করে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সফল ব্যাক্তিদের একজন। সাফল্যের শিখরে উঠলেও নিজের সবচেয়ে কষ্টের দিনগুলোর স্মৃতি ভুলে যাননি রাউলিং। ২০০০ সালে তিনি একটি দাতব্য ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন, যা দুস্থ নারী ও শিশুদের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ পাউন্ডের মতো সহায়তা প্রদান করে থাকে। ২০০৮ সালের ৫জুন হার্ভাড এ্যালামনাই এসোসিয়েশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য দেন।
জে কে রাওলিং: শুরুতেই সবাইকে ধন্যবাদ। হার্ভার্ড আমাকে অসাধারণ সম্মান দিয়েছে। আজ আমাকে এখানে বক্তব্য দিতে হবে, এটা ভেবেই আমার ওজন কমে গেছে ! কিন্তু আমি এজন্য মোটেও চিন্তিত নই, কারণ আমি এখন পৃথিবীর সবচাইতে বড় গ্রিফিন্ড’র পুনর্মিলনীতে আছি।
সত্যি কথা বলতে কি, আজ তোমাদের আমি কী বলবো তা নিয়ে এই ক’দিন আমার মন-মগজ কে খুব ব্যস্ত রেখেছিলাম। ভেবেছি, নিজের গ্র্যাজুয়েশনের দিনে কোন কথাটা জানা আমার জন্য সবচাইতে জরুরি ছিল, আর সেদিন থেকে আজকের মাঝে পেরিয়ে যাওয়া একুশটা বছরে আমি কী শিখেছি। আমি দুটো উত্তর খুঁজে পেয়েছি। তাই আমি ঠিক করেছি, জীবনে ব্যর্থ হবার গুরুত্ব নিয়ে আজ তোমাদের বলবো। আজ যখন তোমরা জীবনের এক চুড়ান্ত বাস্তবতার ধাপে এসে দাঁড়িয়েছ, তখন আমি তোমাদের শোনাবো কল্পনাশক্তির অভাবনীয় প্রয়োজনীয়তার কথা।
আমার কথাগুলো হয়তো তোমাদের কাছে ধাঁধাঁর মতো লাগতে পারে। একটু ধৈর্য ধরে শোনো, আমি বলছি।
আমার আগ্রহের জায়গা ছিল উপন্যাস লেখা, আমি সবসময় এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। তবে তখন অব্দি বাবা-মা’র কাছে আমার কল্পনাশক্তি একটি হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যা দিয়ে না কখনো পেনশন যোগানো যাবে, না কারো ধার শোধ করা যাবে! তবে জানি তাদের সেই বিদ্রুপটা আজ কেমন শোনাচ্ছে।
বাবা-মা চাইতেন আমি যেন কারিগরিতে (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি নেই, কিন্তু আমার আগ্রহ ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারো কথাই টিকল না, আমি আধুনিক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলাম। তোমরা আবার এটা ভেব না যে, বাবা-মাকে আমি দোষারোপ করছি। তোমাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার দায় বাবা-মার ওপর চাপানোর একটা সময়সীমা আছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার মতো বয়স হবার পর কারো কাজের দায় তার ওপরই বর্তায়। তাছাড়া আমি জানি আমাকে কখনো অভাবে পড়তে হবে না আর এটি ভেবে আমি কিছুতেই তাদের দোষারোপ করতে পারি না। আমার বাবা-মা অভাবী ছিলেন, তার মানে আমিও অভাবী ছিলাম। দারিদ্রতা সম্মানের কিছু না তা আমিও জানি। তাই এ ব্যাপারে আমিও আমার বাবা-মায়ের সাথে একমত। অভাবের সাথে জড়িয়ে থাকে ভয়-ভীতি, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ। বুঝতেই পারছো গরীব হওয়ার অর্থ হাজারো অসম্মান আর কষ্ট সহ্য করা। তবে মনে রাখবে নিজের চেষ্টায় অভাবকে জয় করতে পারা কিন্তু অনেক গর্বের ব্যাপার। তাই বলে অভাবকে সাথে নিয়ে কল্পনাবিলাস, অনেকটা রূপকথার জগতের মতোই।
তোমাদের বয়সে একটি জিনিস আমি খুব ভয় পেতাম, আর তা কিন্তু অভাব নয় – ব্যর্থতা। সে বয়সে আমি ক্লাসে লেকচার শোনার চেয়ে কফি বারে বসে গল্প লিখে বেশি সময় কাটিয়েছি। তবে পড়ালেখা নিয়ে আগ্রহ কম থাকলেও পরীক্ষায় ঠিকই পাশ করে যেতাম। পাশ করার গুণ আমার ছিল।
টানেলটা কতখানি দীর্ঘ সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না, বরং টার্নেলের শেষ প্রান্তে আলোর দেখা পাওয়া যতটা না বাস্তব ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল আশা। আমি যে তখন অব্দি বেঁচে ছিলাম সেই উপলব্ধি, আমার একমাত্র আদরের মেয়ে, একটা পুরনো টাইপরাইটার আর দারুণ এক আইডিয়া – এসবের ওপরই আমার নতুন জীবনের ভিত রচনা করেছিলাম।
তোমরা কখনো ব্যথতার মুখোমুথি হবে না এমনটা আমি ভাবছি না, এমন ভাবার মতো বোকা আমি নই। প্রতিভা কিংবা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কখনই ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচা যায় না। তাই আমি নিশ্চিত যে তোমরা প্রত্যেকেই অবিরত সুখ-সুবিধা ভোগ করে এসেছো। তোমরা হার্ভার্ডে পড়েছো তাই হয়তো ব্যর্থতার সাথে তোমাদের তেমন পরিচয় নেই। ব্যর্থ হবার ভয় আর সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা – এ দুটো হয়তো তোমাদের মাঝে সমানভাবেই আছে। ব্যর্থতা কী সেটা জানার জন্য আমাদের নিজেদেরকেই তা উপলব্ধি করতে হবে। পৃথিবীকে তুমি সুযোগ দাও, দেখবে পৃথিবী নিজেই তাকে চেনার কিছু উপায় তোমাদের দেখিয়ে দেবে। এই সুযোগের খেলায় গ্র্যাজুয়েশনের সাত বছরের মধ্যেই আমি বিরাট ব্যর্থতার শিকার হয়েছি।
ব্যর্থ হওয়া একটা আনন্দের ব্যাপার – এমন কথা আমি কখনোই তোমাদেরকে বলবো না। ওটা ছিল আমার জীবনের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। তাছাড়া প্রেস তখনকার যে সিদ্ধান্তটাকে এখন রূপকথার গল্পের মতো করে উপস্থিত করছে, সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না আমার। টার্নেলটা কতখানি দীর্ঘ সে সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না, বরং টার্নেলের শেষ প্রান্তে আলোর দেখা পাওয়া যতটা না বাস্তব ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল আশা। আমি যে তখন অব্দি বেঁচে ছিলাম সেই উপলব্ধি, আমার একমাত্র আদরের মেয়ে, একটা পুরনো টাইপরাইটার আর দারুণ এক আইডিয়া – এসবের ওপরই আমার নতুন জীবনের ভিত রচনা করেছিলাম।
আমার মতো এত বড় ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়তো তোমাদের হতে হবে না। তবে জীবনে চলার পথে কিছু কিছু ব্যর্থতা এড়ানো অসম্ভব। ব্যর্থ না হয়ে বেঁচে থাকাটাও অসম্ভব। তবে তোমরা যদি এমন ভাবো যে, তোমাদের বেঁচে থাকা না থাকায় কিছু আসে যায় না, তাহলে তো ব্যর্থতা এমনিতেই চলে আসে। এক সময় আমি নিরাপত্তাহীন ছিলাম। নিরাপত্তাবোধ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। যা আমি পরীক্ষায় পাশ করেও কখনো অর্জন করতে পারিনি। নিরাপত্তাবোধ আমাকে নিজের সম্পর্কে এমন কিছু জানিয়েছে যা অন্য কোনভাবে জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার যে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, আশাতীত শৃঙ্খলাবোধ আর দারুণ মূল্যবান কিছু বন্ধু আছে – এসবই আমি তখন আবিষ্কার করেছিলাম।
আমার জীবনের সবচেয়ে ভালা অভিজ্ঞতাটা আমি হ্যারি পটার লেখারও আগে অজন করেছিলাম, সেই অভিজ্ঞতার আমাকে সহ অনেক কিছুই ঐ বইগুলোতে পাওয়া যাবে। এই স্ফূরণ এসেছিল আমার একেবারে প্রথম দিককার এক চাকরির হাত ধরে। ২০-২২ বছর বয়সে আমি লন্ডনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সদর দপ্তরের আফ্রিকান রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে বাড়িভাড়া পরিশোধ করেছি; সাথে দুপুরে খাবার সময় গল্প লেখার জন্য পালানোও অব্যাহত ছিল বৈকি!
আমি আফ্রিকান যুবকটির কথা কখনোই ভুলবো না। সে ছিল আমার বয়সী – নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার একজন- যে তার নিজের দেশে অনেক কিছু সহ্য করার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। একটা ভিডিও ক্যামেরার সামনে নিজের ওপর চালানো অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দেয়ার সময় তিনি দারুণভাবে কাঁপছিলেন। আমার চেয়ে এক ফুট লম্বা মানুষটাকে একটা শিশুর মত দুর্বল লাগছিলো তখন। পরে তাকে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমার ওপর; আর এই মানুষটা, নিষ্ঠুরতা যার জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নিখুঁত সৌজন্যের সাথে আমার হাত ধরে আমার সুখ কামনা করেছিলেন।
এই গ্রহের অন্য কোন সৃষ্টির যে ক্ষমতা নেই, এমন ক্ষমতা মানুষের আছে – সে অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোন কিছু শিখতে আর বুঝতে পারে। সে নিজের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানের একজন মানুষের জায়গা থেকে চিন্তা করতে পারে। তবে হ্যাঁ, আমার তৈরি গল্পের জাদুর মতো এটাও এমন একটা ক্ষমতা যেটা নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। এই ক্ষমতাকে কেউ যেমন অন্যদের বুঝতে কিংবা সহমর্মী হতে ব্যবহার করতে পারে, ঠিক তেমনি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতেও।
আবার অনেকে আছে যারা নিজের কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতে মোটেও আগ্রহী না। নিজেদের অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে নিশ্চিন্তে বসে থাকতেই তাদের সুখ, তাদের যে অবস্থায় জন্ম হয়েছে তার অন্যথা হলে পরিস্থিতি কেমন হতো সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভাবারও অবকাশ নেই এদের। তারা কারো আর্তচিৎকার শুনতে কিংবা বদ্ধ খাঁচায় উঁকি দিতে না চাইতে পারে; তারা তাদেরকে স্পর্শ করে না এমন সব কষ্ট থেকে হৃদয়-মনকে দূরে রাখতে পারে; তারা অনায়াসে কোন কিছু না জেনে থাকতে পারে।
তোমরা যদি তোমাদের ক্ষমতা আর অবস্থানের জোরে তাদের হয়ে কথা বলো যাদের ভাষা নেই; যদি তোমরা নিজেদেরকে কেবল শক্তিশালীদের অন্তর্ভুক্ত না করে শক্তিহীনদের একজনও মনে করো; যারা তোমাদের মতো ভাগ্যবান নয় তোমরা যদি তাদের অবস্থানে নিজেদের কল্পনা করো, তবে কেবল তোমাদের গর্বিত পরিবারই না, তোমরা যাদের জীবন পালটে দেবে সেই লাখো মানুষ তোমাদের অস্তিত্বের জন্য নিজেদের ধন্য মনে করবে। পৃথিবীকে বদলে দেবার জন্য আমাদের জাদুর দরকার নেই; এ জন্য যে ক্ষমতা দরকার তা ইতোমধ্যেই আমাদের ভেতরে আছে, সেটা হল কল্পনা করার ক্ষমতা।
আমার বক্তব্যের শেষে তোমাদের একটা আশার কথা বলবো, ২১ বছর বয়সে আমার যা ছিল। গ্র্যাজুয়েশন ডে-তে যাদের সাথে আমি বসেছিলাম, তারা আমার সারা জীবনের বন্ধু। আমার বাচ্চাদের অভিভাবক, আমার বিপদের সহায় এই মানুষগুলো।
আজ তোমাদের জন্য অমন বন্ধুত্বের চাইতে ভালো আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। আর আগামীকাল আমার বলা একটা কথাও যদি তোমাদের মনে না থাকে, তবু সেনেকা নামের সেই বুড়ো রোমানের কথাটা মনে রেখো, ক্যারিয়ারের সিঁড়ি থেকে পালিয়ে প্রাচীন প্রজ্ঞার খোঁজে ক্ল্যাসিকের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় যার সাথে আমার দেখা: “জীবন গল্পের মতো : তবে তার ব্যাপ্তি নয় বরং সুন্দর্যই আসল।”
আমি তোমাদের সবার সুন্দর জীবন কামনা করি। অনেক ধন্যবাদ
হার্ভাড বিশ্ববিদ্যাল ওয়েব অবলম্বনে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর: রবিউল কমল