‘ক্যারিশমা’ শিখুন, দুর্দান্ত বাঁচুন : দানিশ শেখ
ভারতের প্রথম ‘ক্যারিশমা’ কোচ দানিশ শেখ। জন্ম ভারতের ইন্দোরে। মাত্র ২০ বছর বয়সে মাইক্রোসফ্টের একটি প্রজেক্টে ১০০ জনের বেশি একটি দলকে নেতৃত্ব দেন দানিশ। ২১ বছর বয়সে লিয়ন ব্রিজ (Lionbridge Inc.) কোম্পানিতে সর্বকনিষ্ঠ গ্লোবাল প্রজেক্ট ম্যানেজার পদে যোগ দেন। ২২ বছর বয়সে তাঁর ডাক আসে Yahoo! India থেকে। সেখানেও সংস্থার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ International Product Manager (Yahoo! Mail, Yahoo! Messenger) হিসেবে জায়গা করে নেন তিনি। তাঁর ক্যারিশমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলিউডের বেশ কয়েকজন তারকা ইতিমধ্যেই নাম লিখিয়েছেন দানিশের পাঠশালায়। সম্প্রতি মুম্বাইয়ের জয় হিন্দ কলেজে হিউম্যান নেটওয়ার্ক শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে দানিশ এই বক্তব্য দেন। ভারতীয় বিভন্ন পত্রিকা অবলম্বনে তাঁর সেই বক্তব্য তুলে ধরেছেন মারুফ ইসলাম।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে ক’জন আর জন্মান? অসুখ–বিসুখ থেকে সাত হাত দূরে থাকেন, এমন ক’জন আছেন? সবসময় আনন্দে থাকেন, দুঃখ ছুঁতে পারে না, এমনই বা ক’জন?
না, সংখ্যায় গুনতে গেলে, ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হবে। কিন্তু, এমন কিছু মানুষ তো আছেন, যাঁরা হাসতে হাসতেই করে ফেলেন সব! যাঁরা অনায়াসেই ভিড়ের মধ্যে হয়ে উঠতে পারেন অনন্য। যাঁদের কথা, শরীরী ভাষা, হাঁটাচলায় ধরা দেয় ব্যক্তিত্ব। নিজস্বতা। সাধারণের ভাষায়, ভাবনায়, এঁদের ‘এক্স–ফ্যাক্টর’ আছে। এই ‘এক্স–ফ্যাক্টর’ কী? চলতি কথায়, বহুল ব্যবহার ঘটে যে শব্দের, তা আহামরি কিছু নয়। ‘ক্যারিশমা’।
এই ক্যারিশমার পেছনেই আমি ছুটেছি বরাবর। ক্যারিশমা বিষয়টা আমাকে সবসময় টানত। ফাঁকা সময়ে এনিয়ে নিয়ে ভাবতাম। এভাবেই স্টেপ বাই স্টেপ একটা শেখানোর পদ্ধতি তৈরি করলাম। যা একজনকে ক্যারিশমাটিক হতে সহায়তা করবে। বিজনেস স্কুলগুলোতে গেস্ট টকে অংশ নিতাম। এই ‘ক্যারিশমা কোচিং’ খুব শিগগিরই শখ থেকে ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল।
আমার জন্ম ভারতের ইন্দোর প্রদেশে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। ছোটবেলায় ভীষণ লাজুক ছিলাম। খুব চুপচাপ থাকতাম। পড়াশোনাতেও ছিলাম খুবই খারাপ। পরীক্ষায় পাস করতাম না। ফলে, দিন দিন আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আমার খুব বেশি বন্ধু ছিল না। আসলে কেউ আমার সঙ্গে বন্ধুত্বই করতে চাইত না। তাই কারও সঙ্গে খেলতে বেরোব, ঘুরতে যাব, আড্ডা দেব, এমন সুযোগও ছিল না। বড্ড একঘেয়ে ছিল সবকিছু। কিন্তু ষোলো বছর বয়সে, হঠাৎ করেই জীবনটা বদলে গেল। ডেল কার্নেগি–র বই, ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল’ পড়ে। বইটা পড়ার পর মনে হল, ব্যক্তিত্বে কিছু বদল আনলে আমিও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারব। আমারও বন্ধু হবে। জানেন, সত্যিই বদল এল। কার্নেগি–র বইয়ের মতো, একের পর এক বই পড়তে শুরু করলাম। সেই সঙ্গে নিজেকে বদলানোর চেষ্টাও চলল। বইয়ের পাতায় লেখা আছে যা, তা বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। বুঝিনি, হোঁচট খেয়েছি আমিও। তবে হাল ছাড়িনি। বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করতে করতে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের, একেবারে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলা, আলাপ করা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে সামাজিক হয়ে উঠলাম আমি। লোকের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে লাগলাম। জীবন যে যে সুযোগ দিল, তা গ্রহণ করলাম। ওই সময়ই বুঝতে পারলাম, ভাল ব্যবহার করলে, লোকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। মানুষ তাকে মন থেকে গ্রহণ করে।
সে যাইহোক। আমি কীভাবে ক্যারিশমা রপ্ত করলাম সেই গল্প বলি। ‘ক্যারিশমা কোশেন্ট’ বা সি কিউ রপ্ত করার দুটি পদ্ধতি আছে। ১.আউটসাইড–ইন, ২. ইনসাইড–আউট।
আউটসাইড–ইন:
এর অর্থ হল, বাহ্যিক রূপে বদল। যেমন শরীরী ভাষা, প্রাণশক্তি, গলার স্বর, বিশ্বাসযোগ্যতা— এগুলোর ওপর নির্ভর করে ‘ক্যারিশমা’। সহজেই রপ্ত করা যায় ব্যাপারটা। আসলে এই ব্যাপারগুলো সব ঠিক ঠিক করলে, আত্মবিশ্বাস এমনিই বেড়ে যায়। মানসিকভাবে চাঙ্গা থাকা যায়।
ইনসাইড–আউট :
সব ধরনের পরিস্থিতি, সে যত কঠিনই হোক না কেন, ‘ক্যারিশমা’ দেখাতে চান যাঁরা, তাঁদের ইনসাইড–আউট পদ্ধতি নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে দীর্ঘ ভাবনা–চিন্তা দরকার। বেশি বেশি পড়াশোনা, দীর্ঘ ভাবনা–চিন্তা মনের ভেতর বাড়তি আত্মবিশ্বাস জাগায়। আপনাকে সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু করে দেখানোর শক্তি জোগায়। আগে যা মনে করতেন অসম্ভব, তাই তখন সম্ভব বলে মনে হবে। তবে এক্ষেত্রে বাড়তি নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা থাকা দরকার। সেটা করতে পারলে, ফল একদিন না একদিন পাবেনই।
হয়ত কেউ কেউ সহজেই ‘ক্যারিশমা’ রপ্ত করেন। কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দীর্ঘমেয়াদি হয়। হয়ত পুরো জীবনটাই পেরিয়ে যায়। তবে কঠিন অঙ্ক শিখে ফেলার যেমন সহজ ফর্মুলা থাকে, তেমনি ‘ক্যারিশমা’র ক্ষেত্রেও আছে সহজ উপায়।
বাহ্যিক ‘ক্যারিশমা’ রপ্ত করার সহজ পদ্ধতি
শরীরী ভাষা: সোজা হয়ে দাঁড়ান। মুখ নিচু করে নয়, চিবুক থাকুক একটু ওপরে। হাঁটাচলার সময় যেন আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ে। অযথা মাথা নাড়ানো, মোটেই ঠিক নয়। পা মুড়ে বা বেঁকিয়ে, কাঁধ ঝুকিয়ে দাঁড়াবেন না। অন্তর থেকে হাসুন। নকল হাসি নয়। মঞ্চে উঠে দু’হাত পকেটে পুরে, টেবিলের আড়ালে দাঁড়াবেন না কখনই।
কথা বলার ভঙ্গি: হয়ত দুই বক্তা একই বিষয়ে কথা বলছেন। কিন্তু একজন অনেক তাড়াতাড়ি, গলা খুলে, নাগাড়ে বক্তব্য রাখছেন। আর আরেকজন হোঁচট খাচ্ছেন বলতে গিয়ে। সবাই প্রথম বক্তার কথাই শুনতে চাইবে। মনে করবে, তাঁর মধ্যে ভরপুর প্রাণশক্তি আছে। তাঁকে বুদ্ধিমান আখ্যাও দেবে।
চোখের দৃষ্টি: চোখের দিকে না তাকিয়ে, আকাশ–পাতালের দিকে তাকিয়ে থাকলে লোকে মনে করবে আপনি লাজুক। তাই চোখে–চোখ রেখে কথা বলুন। তা হলে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী মনে করবেন সবাই।
পোশাক: অনুষ্ঠান, পরিস্থিতি বুঝে পোশাক পরুন। আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের প্রায় সব মানুষই প্রথম দর্শনে বিশ্বাসী। পোশাক কেমন পরে আছেন, তা দেখে বিচার করার চেষ্টা করেন। ধারণা তৈরি করে নেন। কেউ দামি শার্ট পরে থাকলে বা ডিজাইনার পোশাক পরলে তাকে দেখা মাত্রই মনে করা হয়, উচ্চবিত্ত। নিশ্চিতভাবেই ভদ্র পরিবারের। বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ। আবার ময়লা পোশাক পরলে, ধারণাটা ঠিক উল্টো তৈরি হয়। তাই কী পোশাক পরছেন, কোথায় পরছেন সেটা জরুরি। শুধু জামা নয়, ঘড়ি, জুতো, চশমা— সব কিছুই ভেবে–চিন্তে পরুন। তবে নতুন কিছু পরতে বা নতুন ফ্যাশন করতে ভয় পাবেন না। চ্যালেঞ্জটা নিন।