আমার দিন কাটত ক্ষুধার জ্বালায় : বান কি মুন
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ায়, ১৯৪৪ সালের ১৩ জুন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর মুন এই অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য দেন। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশের ভাষান্তর করেছেন মারুফ ইসলাম।
বছর চল্লিশেক আগের কথা। আমি তখন অনেক ছোট, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করি। খবর পেলাম, কোরিয়ার একজন শিক্ষার্থীকে চীনা স্টাডিজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ অবৈতনিক বৃত্তি দিতে ইচ্ছুক। ওই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিই হলো এই ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন। আমি বৃত্তিটা পাওয়ার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম। রাতদিন পড়াশোনা আর পড়াশোনা। বেশি বেশি পরীক্ষা দিলাম। বলা যায় উদয়াস্ত পরিশ্রম শুরু করলাম।
একদিন আমার নামে একটি চিঠি এল। চিঠির মর্মার্থ হচ্ছে, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন আমাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডেকেছে! আমি মহা উত্তেজিত। সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে সিউলের রয়েল হোটেলে। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সুযোগটা পাব। যখন রয়েল হোটেলে গেলাম, দেখতে পেলাম, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে আসা এক অধ্যাপকের কাছে ভাইভা দেওয়ার জন্য অধ্যাপক ও সরকারি কর্মকর্তাসহ ১২ জন কোরীয় অপেক্ষা করছেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম, এই শিক্ষার্থী নির্বাচন শুধু কোরিয়া থেকেই নয়, পুরো এশিয়া থেকে মাত্র একজনকে নির্বাচন করবে যুক্তরাষ্ট্র।
হতাশ মন নিয়ে পরীক্ষা দিলাম। সাক্ষাৎকার দিলাম। সৌভাগ্যবশত কোরিয়া থেকে আমিই নির্বাচিত হলাম। আরেক দিন, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে আরেকটি চিঠি এল। চিঠির শুরুতে বলা হয়েছে, সংবাদটা আনন্দের। কিন্তু পুরো চিঠি পড়ে আমি মোটেও আনন্দিত হতে পারলাম না। তারা বলেছে, আমি নির্বাচিত হয়েছি প্রথম রানারআপ হিসেবে। যদি প্রথমজন সুযোগটা না নেয়, তাহলে আমাকে সুযোগটা দেওয়া হবে। চিঠিতে আরও লিখেছে, অপেক্ষা করো।
কি আর করা! অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। অপেক্ষা…আরও অপেক্ষা…। অপেক্ষা আর শেষ হয় না। অবশেষে ৪০ বছর পর আমার অপেক্ষার অবসান হলো। হ্যাঁ, ঠিক ৪০ বছর পর আজ আমি ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে আসার সুযোগটা পেয়েছি! তোমাদের জন্য অনেক অনেক অভিনন্দন। তোমাদের এই জাঁকজমক ও বনেদি পরিবারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমার সামনে যারা বসে আছ, কিছু প্রবীণ ছাড়া তোমরা সবাই তরুণ। তোমাদের মুখের চেহারায় আমি পুরো পৃথিবীটাকেই দেখতে পাচ্ছি। যেন তোমরাই গড়ে তুলেছ জাতিসংঘ। আমাদের একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম ঠিকই, কিন্তু আমাদের সবার স্বপ্ন একটাই। জাতিসংঘও একটিমাত্র স্বপ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই স্বপ্নটা হলো একটা প্রত্যয়: সর্বনাশা যুদ্ধের কালো অভিশাপ থেকে আগামী প্রজন্মকে মুক্ত করা। এই স্বপ্নটা হলো মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করা। সামাজিক উন্নয়ন ও স্বাধীনতার সঙ্গে আদর্শ জীবনব্যবস্থার প্রবর্তন করা। এটাই জাতিসংঘ সনদের প্রত্যয়।
বিশ্বের যে দেশেই আমি যাই, যখনই আমি বিশ্বনেতাদের সামনে ভাষণ দিই, আমি তাঁদের জাতিসংঘ সনদের কথা স্মরণ করিয়ে দিই। আমি জবাবদিহির কথা বলি, বলি ন্যায়বিচারের কথা। আমি অধিকার ও কর্তব্যের কথা বলি।
আজ এই সমাবর্তনে তোমরা যারা তরুণ, তোমাদের উদ্দেশ করেই আমি বলছি। তোমাদের শক্তি, সফল হওয়ার আত্মবিশ্বাস ও নায়বিচারের বোধ বিকশিত করো এবং তোমাদের ভেতরের সুপ্ত বাসনা প্রস্ফুটিত করো।
আমি বেড়ে উঠেছি যুদ্ধ-পরবর্তী কোরিয়ায়। আমি যখন ছোট ছিলাম, সে সময় আমাদের আশপাশের সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আমরা নিঃস্ব, অসহায়, হতদরিদ্র হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের দিন কাটত ক্ষুধার জ্বালায়। ঘরবাড়ি, শহর—সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। হারালাম অনেক বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন। এরপর এল জাতিসংঘ। আশায় বুক বেঁধে সবকিছু নতুন করে গড়ে তুলতে জাতিসংঘ আমাদের সাহায্য করল। তখন জাতিসংঘ আমাদের কাছে এসেছিল আশার আলো হয়ে। এমনকি এখনো, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক মানুষের আশার প্রদীপ এই জাতিসংঘ।
আমি স্বপ্ন দেখতাম, বিশ্বটাকে অনেক সুন্দর করে গড়ে তুলব। এবার তোমাদের পালা। এবং আমার নিজেরও। এসো, আমরা সবাই ঐক্য গড়ে তুলি। এসো, একটি সুখী পৃথিবীর জন্য কাজ করি; এমন পৃথিবী, যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে না; এমন পৃথিবী, যেখানে একটিও শিশু আর ক্ষুধার জ্বালায় কাতরাবে না। এসো, সেই পৃথিবীর জন্য কাজ করি, যেখানে ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে স্কুলে যাবে। যেখানে সবার জীবন সুস্থ, সুখী ও সফল হবে।
এসবই জাতিসংঘের স্বপ্ন। এসব মানুষের মৌলিক অধিকার। বিপদে বিশ্বের যত পুরুষ, যত নারী ও শিশু—সবার পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্বটা এসো কাঁধে তুলে নিই। এসো, সবার স্বপ্নগুলো সত্য করতে সাহায্য করি।