বন্ধু ছিল টনি ব্লেয়ার : রোয়ান অ্যাটকিনসন
মি. বিন নামের আড়ালে হারিয়ে গেছেন রোয়ান সেবাস্টাইন অ্যাটকিনসন। এখন গোটা পৃথিবী তাঁকে চেনে মি. বিন নামে। কিন্তু তিনি যখন রোয়ান ছিলেন- ছিলেন ছোট্ট শিশু, কিশোর, তরুণ-তখন কেমন ছিল তাঁর জীবন? যখন মনে পড়ে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার আর তিনি একই সঙ্গে একই স্কুলে পড়ালেখা করেছেন তখন কেমন অনুভূতি খেলা করে তাঁর মনে? বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেসব স্মৃতির কথা বলেছেন এই কিংবদন্তী কমেডি অভিনেতা। ইংরেজি থেকে নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম।
আমার সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের ধারনা এরকম যে, আমি সিনেমায় যেরকম মানুষ হাসাই, বাস্তবেও সবাইকে হাসাব। বিষয়টা আসলে পুরোপুরি উল্টো। বাস্তব জীবনে আমি খুবই চুপচাপ স্বভাবের। প্রয়োজন না হলে খুব একটা কথা-টথা বলি না। তবে, হ্যাঁ, প্র্যাকটিক্যাল জোক খুব পছন্দ করি।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, মি.বিন কী কারণে এতটা জনপ্রিয়? এর উত্তরে আমি বলি, মি. বিনের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো, সে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের খোলসে লুকিয়ে থাকা একটা শিশু। সব দেশে সব জায়গায় শিশুরা একই রকম। পৃথিবীর সবখানে শিশুদের ভাব প্রকাশের ভঙ্গি একই রকম। আমি যখন মি. বিন চরিত্রে অভিনয় করি তখন এই ব্যাপারটা মাথায় রাখি। যেটুকু কথা না বললেই নয় সেটুকু বলি আর বাকিটা শিশুদের মতো অঙ্গভঙ্গি দিয়ে প্রকাশ করি। সম্ভবত এই কারণেই পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষ আমার ভাষা বুঝতে পারে। আমাকে অর্থাৎ মি. বিনকে তারা পছন্দ করে।
হাস্যরস বিষয়টা ছোটবেলা থেকেই আমার সঙ্গী। তবে ভবিষ্যতে হাস্যরসই আমার পেশা হবে সেটা অবশ্য কখনো ভাবিনি। আমার বাবার ছোট্ট একটা খামার ছিল। আর মা ছিল গৃহিনী। বাড়ির পরিবেশের কারণে ছোটবেলাতেই অমি বুঝতে শিখেছি যে, আমারা খুব একটা ধনী নই। বলা চলে বেশ সাদামাটাভাবেই আমার ছেলেবেলা কেটেছে। একটু বুদ্ধি হওয়ার পরই দেখলাম, আমার বড় দুই ভাই পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছাড়লেন। এর কিছুকাল পর বড় দুই ভাইয়ের মতো আমাকেও পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছেড়ে ডারহাম যেতে হলো। সেখানে আমি ডারাহাম ক্যাথিড্রাল স্কুলে ভর্তি হলাম।
এই স্কুলের কথা মনে হলেই আমার টনির কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ, বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের কথা বলছি। টনি আর আমি একই সঙ্গে পড়তাম। সে ছিল বেশ গম্ভীর স্বভাবের। আর আমি ছিলাম রসিক। তারপওর আমাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব ছিল। ভাবতে ভালোই লাগে যে, একজন প্রধানমন্ত্রী আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল।
এখানে একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমি কিন্তু বরাবরই ক্লাসে প্রথম সারির শিক্ষার্থী ছিলাম। তাই বলে ভাবার কারণ নেই যে, আমি সব সময় পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম! আমি ওই স্কুলে একটি ফিল্ম সোসাইটিও চালাতাম, যার কাজ ছিল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শিশুতোষ এবং হাসির সিনেমা দেখানো।
এ পর্যায়ে একটি অবিশ্বাস্য তথ্য দেই। আমার ১২ বছর বয়সের আগে আমি কখনো টেলিভিশন দেখিনি। সেই আমিই কিনা ফিল্ম সোসাইটিতে চার্লি চ্যাপলিন, লরেল অ্যান্ড হার্ডি—প্রমুখদের সিনেমা দেখে নিজের অজান্তেই তাঁদের নকল করতে শুরু করি। আমি স্কুলের মঞ্চনাটকে ব্যাকস্টেজে কাজ করতাম। কিন্তু যখন মঞ্চে অভিনয় করতাম, তা হতো আরও ভালো। এ রকম দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাকে প্রথমবারের মতো বলেন অভিনয়টাকে সিরিয়াসলি নিতে। আমি নিয়েওছিলাম। আমার অভিনয় দিয়ে সহপাঠীদের, শিক্ষকদের সব সময় হাসিয়েছি। পাশাপাশি আমার যে মূল দায়িত্ব অর্থাৎ পড়ালেখা করা সেটাও কিন্তু পালন করেছি ঠিকভাবে। পরীক্ষায় সব সময় ভালো নম্বর তুলতাম। এজন্য আমার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়নি। নিয়ম মাফিক পাশ করে একসময় নিউ ক্যাসেল ইউনিভার্সিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এবং এভাবেই একদিন তড়িৎ প্রকৌশলী হয়ে গেলাম।
তবে প্রকৌশলের ওপর আমার থিসিস জমা দেওয়ার আগেই একটি কঠিন এবং গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। সেটা হলো, আমি কখনো প্রকৌশলে ক্যারিয়ার গড়ব না। আমি ক্যারিয়ার গড়ব অভিনয়েই এবং কমেডিতে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি আর আমার দুই বন্ধু এক অনুষ্ঠানে মঞ্চাভিনয় করে সাড়া ফেলে দিলাম। ওখানে আমার অভিনয় দেখেছিলেন এক সুপ্রতিষ্ঠিত ফিল্ম এজেন্ট। আমার অভিনয় তাঁর ভালো লাগল। তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। তার পর থেকে তিনি আমারও এজেন্ট হয়ে গেলেন। আমার ভাগ্যের মোড় ঘুরে গেল। বিয়ন্ড দ্য জোক-এ অভিনয় করলাম। তারপর বিবিসিতে অনুষ্ঠান করার আমন্ত্রণ পেলাম। আমি তখন যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যা-ই হোক, বিবিসিতে ‘নট দ্য নাইন ওক্লক নিউজ’ অনুষ্ঠানটি আমাকে খ্যাতি এনে দিল। এরপর ‘দ্য ব্ল্যাক এডর সিরিজ’ আমাকে মানুষের কাছে আরও বেশি পরিচিত করে দিল। অনুষ্ঠানটি এত জনপ্রিয়তা পেল যে এটার পাঁচটি সিরিজ তৈরি হলো।
এবার বলি আমার আরেক জীবনের কথা, যে জীবনে আমি মি. বিন। হ্যাঁ, মি. বিন হলো আমার আরেক সত্তা, আরেক জীবন। মি. বিনের মূল চরিত্রে অভিনয় আমাকে পুরো বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে তুলেছে। আমি যেখানেই যাই না কেন, লোকজন আমার পিছু ছাড়ে না। তারা আমাকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে মি. বিন চরিত্রের কারণে। নব্বই দশকের শুরুতে মি. বিন সিরিজ টিভিতে আসার পর থেকে ২০ বছর ধরে আমি এই চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছি। শুরুতে শুধু টিভি সিরিয়াল ছিল, কিন্তু যখন মি. বিন নিয়ে সিনেমা এল, তখনো আমি দর্শকদের মন খুলে হাসার সুযোগ করে দিয়েছি।
সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী করে আমি এমন একটা চরিত্র ফুটিয়ে তুলি। জবাব খুব সহজ। আমি খুব সিরিয়াসভাবে কমেডি করার চেষ্টা করি। সমস্ত সময় মানুষ আমার অঙ্গভঙ্গি দেখেই হাসে, কথা বলি অতি সামান্য। অন্যকে হাসিয়ে নিজেও হাসি। আমি অনেক বাকপটু চরিত্রেও অভিনয় করেছি, যেখানে আমাকে অনেক বেশি কথা বলতে হয়েছে। কিন্তু আমি মি. বিন চরিত্রে অভিনয় করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ, ‘কথা কম, কাজ বেশি’-এই নীতিতে আমি বিশ্বাস করি।
তথ্যঋণ : আইএমবিডি, উইকিপিডিয়া এবং রোয়ান অ্যাটকিনসনের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার।