ড. ইউনূসের ৬ মন্ত্র
কাজী মিশু : ১৯৬৯ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনিস স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এক বাঙালি তরুণ। এর বছর দুই পরই বাংলাদেশে শুরু হয়ে মুক্তিযুদ্ধ। বিদেশের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত মাতৃভূমিকে গড়তে তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসবে বাংলাদেশে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ তার হৃদয়কে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি নিজেকে সমাজকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তীব্র তাগিদ অনুভব করেন।
১৯৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। ৮৫৬ টাকা পুঁজির গ্রামীণ ব্যাংক লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেয়। তিনি এবং গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬ সালে নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক মডেল গ্রহণ করেছে বিশ্বের ১০০ টিরও বেশি দেশ। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস।
একজন সফল সমাজকর্মীর পাশাপাশি মুহাম্মদ ইউনুস একজন সফল উদ্দক্ত্যা। মুহাম্মদ ইউনুসের জীবনের আলোকে আজকে আমরা আলোচনা করব ৬টি বিষয়। যারা সফল উদ্দক্ত্যা হতে চান তাদের এই ছয়টি বিসয় আবশ্যই জানা জরুরি।
১. নতুন বাজার তৈরী
- এক সময় ব্যাংক শুধু তাদেরকে ঋণ দিত যাদের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য আছে। এই ক্ষত্রে মহিলা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী ঋণ সেবা পাওয়ার আওতায় আসত না। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ব্যাংকের গতানুগতিক ধারায় পরিবর্তন আনেন। সাধারণ ব্যাংক ঋণ দেয় বিত্তবানদের কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দেয় বিত্তহীনদের। সাধারণ ব্যাংকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রাধিকার পায় পুরুষরা, আর গ্রামীণ ব্যাংকে আগ্রাধিকার পায় মহিলারা। ঋণ নিতে গেলে সাধারণত ব্যাংকের কাছে ছুটে আসতে হয় কিন্তু ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক ছুটে যায় সাধরণ মানুষের কাছে। একটা সময় দেখা গেল সাধারণ ব্যাংকের তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ খেলাপি প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রামীণ ব্যাংক প্রমাণ করল, বিত্তহীন মানুষরা ঋণ নেওয়ার যোগ্যতা রাখে বরং তারা বিত্তবানদের তুলনায় অনেক ভালো গ্রাহক হতে পারে। এভাবে দরিদ্র এবং গ্রামীণ মহিলাদের ঋণ দেওয়ার একটি নতুন বাজার তিনি সৃষ্টি করলেন। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরেণ গড়ে উঠল নানান ঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান।
২. বড় স্বপ্ন দেখতে হবে
- ড. ইউনুস বলেন, ‘কখনো ছোট চিন্তা করবে না। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে কিন্তু খুব ছোট পরিসরে শুরু করতে হবে।’ নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন, ‘যে কোনো উদ্যোগ শুরু করার আগে পর্যন্ত কঠিন মনে হয়।’ ইউনুস প্রাথমিকভাবে গ্রামের কয়েকজন মহিলার মাঝে ৮৫৬ টাকা ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম পদক্ষেপ শুরু করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে যখন গ্রামীণ ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল তখন এটির ৮৬ টি শাখা এবং ৫৮ হাজার ঋণ গ্রাহীতা ছিল। ২০১০ সালে এর শাখা এসে দাঁড়ায় ২৮ হাজারে অর ঋণগ্রহীতার সংখ্যা হয় ৭০ লাখ। প্রতিষ্ঠানের এই সাফল্যের মূল কারণ ছিল ইউনুসের দূরদর্শিতা। কেনন না তিনি তার সেবা কয়েক হাজার মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে বিশ্বকে পরিবর্তন করার।
৩. গড়ে তুলুন সহযোগিতার সম্পর্ক
- গ্রামীণ ব্যাংক বেড়ে উঠেছিল বিদেশি সাহায্য এবং অনুদানের উপর নির্ভর করে। এটা সম্ভব হতো না যদি ইউনুস একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যপারে আগ্রহী না হতেন। গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও তিনি অনেকগুলো ব্যবসায়িক উদ্যোগ চালু করেছিলেন। তার মধ্যে ফ্রেঞ্চ বহুজাতিক কোম্পানি ডানোনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০৭ সালের গ্রামীণ এবং ডানোনের যৌথ মালিকানায় জন্ম নেয় গ্রামীণ-ডানোন কোম্পানি। সেই সাথে আত্নপ্রকাশ করে বিশ্বের প্রথম সামাজিক ব্যবসা। তারও আগে ১৯৯৭ সালে ড. ইউনুস এবং ইকবাল জেড কাদিরের যৌথ উদ্যোগে আত্নপ্রকাশ করে দেশের প্রথম এবং বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোন।
৪. ব্যবসায়ে বৈচিত্র্য আনুন
- গ্রামীণ ব্যাংকের আকশচুম্বি সাফল্য ড. ইউনুসকে শান্ত করতে পারেনি। ১৯৮০ সালের পর গ্রামীণ নতুন নতুন স্বতন্ত্র প্রকল্প প্রণয়ন করতে থাকে যেমন, গ্রামীণ মৎস্য, গ্রামীণ কৃষি, গ্রামীণ ট্রাস্ট, গ্রামীণ শিক্ষা, গ্রামীণ সফটওয়্যার, গ্রামীণ সাইবার নেট, গ্রামীণ ফোন, গ্রামীণ নিটওয়্যার ইত্যাদি।
৫. অন্যকে উৎসাহিত করুন
- আপনার ব্যবসায়িক উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরাও আপনাকে অনুকরণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নতুন নতুন ব্যবসার উদ্যোগ গড়ে উঠতে উৎসাহ ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগের পাশাপাশি ড. ইউনুস গড়ে তুলেছেন বহু সহযোগী প্রতিষ্ঠান যারা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী পর্যায়ে সামাজিক ব্যবসা গড়ে উঠতে সহযোগিতা করে। তার মধ্যে ইউনুস সোশ্যাল বিজনেস, গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যব উল্লেখযোগ্য। তরুণদের সামাজিক ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করতে এবং সযোগিতা করতে গড়ে তুলেছেন ওয়াই ওয়াই (ইউনুস অ্যান্ড ইয়ুথ) ফাউন্ডেশন।
৬. সমালোচনার জন্য প্রস্তুত থাকুন
- কাজ করলে সমালোচনা আসবেই। একটা কথা বলা হয়ে থাকে, যাকে নিয়ে আলোচনা হয় তাকে নিয়ে সমালোচনাও হয়। নিন্দুকের সমালোচনা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত হতে হবে। সমালোচনা বা নিন্দার ভয়ে নিজের ব্যবসায়িক উদ্দ্যোগের গতি শ্লথ বা বন্ধ করা যাবে না। দেশে বিদেশে ড. ইউনুসের কাজ একদিকে যেমন প্রশংসা অর্জন করেছে অপরদিকে নিন্দা ও অপবাদ কুড়িয়েছে। দেশি বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম তার মাইক্রো ক্রেডিট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু তাতে ড. ইউনুসের কাজের গতিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং তিনি দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে চলেছেন সামাজিক ব্যবসার ধারণ নিয়ে। জাতিসংঘের এমডিজি এবং এসডিজি গোল অর্জনে সামাজিক ব্যবসার ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইতালি, জাপান, জার্মানে গড়ে উঠেছে সামাজিক ব্যবসার শহর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে সামাজিক ব্যবসার গ্রাম। মাইক্রোসফট, ভার্জিন, ইনটেল, আইবিএম সহ বিশ্বের অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মূল ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসা চালু করেছে।
লেখক : সভাপতি, সোশ্যাল বিজনেস স্টুডেন্টস ফোরাম, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
তথ্য ঋণ : নেলসন ভিনডোস মোজেস, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের লড়াই (সেলিনা সিরাজ ও শিপ্রা চক্রবর্তী), সামাজিক ব্যবসা (মুহাম্মদ ইউনুস), উইকিপিডিয়া