অজ্ঞতা কোনো গুণ নয় : বারাক ওবামা
- লিডারশিপ ডেস্ক :
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর সাফল্য, ব্যর্থতা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে একজন দারুণ বক্তা, সেটা নিশ্চয়ই তাঁর নিন্দুকও মানবেন। গত ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি।
হ্যালো রাটগার্স!
আমাদের সৌভাগ্য, দেশকে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে যে নেতৃত্ব গুণাগুণ দরকার, তা তোমাদের আছে। আমি নিশ্চিত, তোমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানো। ভয়, দলাদলি, উদ্যমহীনতা তোমাদের পথ রোধ করতে পারে না। পরস্পর সহযোগিতা, উদ্ভাবনী মনোভাব আর স্বপ্ন তোমাদের শক্তি।
তোমাদের ওপর বিশ্বাস আছে বলেই ‘কীভাবে পৃথিবীটা আরও সুন্দর করা যায়’ সে সম্পর্কে আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই না। সেটা তোমরা নিজেরাই খুঁজে নেবে। নবীন চোখে আশপাশটা দেখবে। তোমাদের বাপ-দাদা কিংবা আমার মতো বুড়োর খামখেয়ালি, জড়তা তোমাদের মধ্যে থাকবে না। বিশ্বজয়ের এই অভিযানে কিছু পরামর্শ আমি তোমাদের দিতে চাই, যা হয়তো কাজে আসবে।
প্রথম কথা: অনেককেই বলতে শুনবে, ‘ফেলে আসা দিনগুলো কতই না ভালো ছিল।’ এই কথায় কান দিয়ো না। আমরা একটা দারুণ জাতি এবং আমরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে গর্বিত। পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাহস আর শ্রমের বিনিময়েই আজ আমরা এখানে পৌঁছেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যেই একটা কাল্পনিক অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করার প্রবণতা আছে। বিশেষ করে মানুষ যখন একটা পরিবর্তন, একটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যায়, তখনই তারা পেছনে ফিরে তাকায়। তারা এমন একটা অতীত ‘কল্পনা’ করে, যখন সব ঠিকঠাক চলছিল। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিচক্ষণতা ছিল, ছেলেমেয়েরা খুব ভদ্র-সভ্য ছিল এবং আমেরিকা পৃথিবীর প্রতি তার দায়িত্ব পালন করছিল।
কিন্তু সত্য হলো, ব্যাপারটা তা নয় (হাসি)। অতীতের ‘বড় ভালো দিন’গুলো আসলে এতটাও ভালো ছিল না। হ্যাঁ, আমাদের ইতিহাসে এমন কিছু সময় গেছে যখন অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হয়েছে, সরকার আরও সুচারুভাবে দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু ৫০ বছর, ৩০ বছর, এমনকি ৮ বছর আগের তুলনায়ও পৃথিবীবাসী এখন ভালো আছে। সব দিক থেকেই।
তোমাদের মনকে প্রসন্ন করতে এসব বলছি না। নিশ্চয়ই আমাদের বড় কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো সমাধান করতে হবে। কিন্তু আমি যা বলতে চাইছি তা হলো ইতিহাসে পরিবর্তন একটা নিয়মিত ব্যাপার। আমেরিকার উন্নতির রহস্য হলো, আমরা পেছনে ফিরে তাকাই না। আমরা ভবিষ্যৎকে ভয় পাই না। ভবিষ্যৎকে আমরা নিজের করে নিয়েছি। তরুণেরাই সব সময় পৃথিবীতে বড় বড় পরিবর্তন এনেছে। কারণ তরুণ, তোমরা ভবিষ্যৎকে ভয় পাও না।
এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই আমি দ্বিতীয় কথাটা বলতে চাই। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ, প্রত্যেকটা জিনিস আগের চেয়েও একে অপরের সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত। দেয়াল তুলে দিলেই এই সম্পর্ক ভেঙে যাবে না।
দেখো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার প্রথম কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা আর উন্নয়ন নিশ্চিত করা। জাতি হিসেবে অবশ্যই আমাদের কাছে নিজের দেশ সবার আগে। কিন্তু গত দুই দশকে আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাটাই সব সমস্যার সমাধান নয়। বাইরের দেশগুলোতে যখন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়, তার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়ে। জিকা কিংবা ইবোলা ভাইরাস আমেরিকানদের জন্যও একই রকম হুমকির কারণ। দেয়াল তুলে দিলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না।
তৃতীয়ত: তথ্য–প্রমাণ–কারণ–যুক্তি–বিজ্ঞানের জ্ঞান…জীবনে এসবের গুরুত্ব আছে। সাধারণত আমরা এগুলোকে মূল্য দিই। কিন্তু তুমি যদি এ সময়ের রাজনৈতিক আলোচনাগুলো শোনো, দেখবে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতার প্রভাব আছে। অতএব ২০১৬ সালের স্নাতক, তোমাদের আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই: রাজনীতি বলো, কিংবা জীবন, অজ্ঞতা কোনো গুণ নয়। তুমি কী বলছ তুমি যদি না জানো, সেটা তোমার ‘স্মার্টনেস’ নয়। রাজনীতির শুদ্ধতা নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুলতে পারো না, যদি তোমার অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার না থাকো।
তোমাদের প্রত্যেকের পকেটে মোবাইল ফোন আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে তথ্য অনুসন্ধান কখনোই এতটা সহজ ছিল না। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তথ্যের এই অবাধ ভান্ডারই যেন আমাদের সত্য থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো তথ্য এতটা অবারিত বলেই আমরা অজ্ঞতাকে স্বাভাবিক ধরে নিচ্ছি। আমরা ধরেই নিচ্ছি অন্তর্জালে যা আছে সব সত্যি। অনলাইনে আমি তা-ই খুঁজি, যা আমার বিশ্বাসকে সমর্থন করে। মানুষের অভিমত এখানে সত্যের ছদ্মবেশে ধরা দেয়। অকাট্য মিথ্যেটাও বেদবাক্য হয়ে যায়।
দেখো, আমি বলছি না ঠান্ডা মাথায় ভাবা এবং লিখিত প্রমাণের চেয়ে আবেগ, বিশ্বাস, ভালোবাসা, আনুগত্য—এসবের গুরুত্ব কম। আমি শুধু বলছি মানুষের এসব গুণ তখনই ঠিকভাবে কাজ করে যখন আমরা পরিষ্কারভাবে ভাবতে শিখি। আর সেটা অর্জন করতে হলে, সবার জন্য ভালো এমন কিছু করতে হলে, আমাদের মাথাকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের মানতে হবে, তথ্য-প্রমাণের গুরুত্ব আছে। যা বলছি, প্রতিটা কথার দায় আমাদের নিতে হবে। (সংক্ষেপিত)