বিদ্যালয় কী সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করে?
- লিডারশিপ ডেস্ক
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ কেন রবিনসন TED এর একটি কনফারেন্সে একটি বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল “বিদ্যালয় কী সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করে?” তার সেদিনের বক্তব্যটি আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল।
শুভ সকাল। কেমন আছেন আপনারা? আমি শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে চাই এবং সৃজনশীলতা নিয়ে কথা বলতে চাই। আমার কথা হল এখন শিক্ষাক্ষেত্রে সাক্ষরতার মত সৃজনশীলতা একই রকম গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদেরও উচিত এটাকে একই চোখে দেখা।
শিশুদের মধ্যে সাধারণ একটা ব্যাপার হল, ওরা সুযোগ নেয়। ওরা যদি কিছু নাও জানে, তবুও ওরা তা চেষ্টা করে দেখে। ঠিক বলেছি? ওরা ভুল করাকে ভয় পায় না। আমি বলছি না যে ভুল করা আর সৃজনশীলতা একই কথা। আমরা যেটা জানি সেটা হল আপনি যদি ভুল করতে প্রস্তুত না থাকেন, তবে আপনি কখনোই মৌলিক কিছু করতে পারবেন না, যদি ভুল করতে প্রস্তুত না থাকেন। আর যতদিনে এসব শিশুরা পূর্ণবয়স্ক হয়, অধিকাংশই এই ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলে। ওরা নিজের ভুল করা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং আমরা কিন্তু এভাবেই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো চালাচ্ছি। আমরা ভুলকে কলঙ্কিত করি। আমরা এখন এমন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালাচ্ছি যেখানে ভুল করাকে একবারেই নিকৃষ্ট হিসেবে ধরা হয়। আর তার ফল হল, আমরা মানুষকে শিক্ষিত করে তার নিজের সৃজনশীলতার বাইরে এনে ফেলছি। পিকাসো বলে গেছেন, “সব শিশুই জন্মগতভাবে শিল্পী।” সমস্যাটা হল, বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই শিল্পীসত্ত্বাকে ধরে রাখা। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা সৃজনশীলতার ভিতরে বেড়ে উঠি না, ক্রমান্বয়ে আমরা এর বাইরে যেতে থাকি। ভালভাবে বললে, শিক্ষিত হয়ে আমরা এর বাইরে যেতে থাকি। কেন এমন হয়?
পাঁচ বছর আগ পর্যন্তও আমি স্টার্টফোর্ড-অন-এভানে থাকতাম। এমনকি, আমরা স্টার্টফোর্ড থেকেই লস এঞ্জেলসে এসেছি। আপনারা বুঝতেই পারছেন কতটা নিখুঁত ছিল অবস্থান্তরটা ! আসলে, আমরা থাকতাম স্নিটারফিল্ডে, স্টার্টফোর্ডের একটু বাইরে, যেখানে শেক্সপিয়ারের বাবার জন্ম। নতুন কোন ভাবনায় আটকে গেলেন? আমি কিন্তু আটকেছিলাম। শেক্সপিয়ারেরও যে বাবা আছে, তা আপনি কখনো চিন্তা করেন না, করেন কী? কারণ আপনারা নিশ্চয়ই শেক্সপিয়ারকে শিশু হিসেবে চিন্তাই করেন না, তাই না? সাত বছরের শেক্সপিয়ার? আমি কখনোই ভাবিনি। বলতে চাচ্ছি যে, সেও কখনো সাত বছরের শিশু ছিল। সেও কোন শিক্ষকের ইংরেজি ক্লাসে যেত তাই না? সেটা কতটা বিরক্তিকর হতে পারে? “আরো ভালভাবে চেষ্টা কর” শেক্সপিয়ারের বাবা তাকে বিছানায় পাঠিয়ে বললেন “এখুনি ঘুমাতে যাও।” “পেন্সিলটা রেখে দাও। আর এভাবে কথা বলা বন্ধ কর। এটা সবাইকে মাথা খাচ্ছে।”
সেকথা থাক, আমরা স্টার্টফোর্ড থেকে লস এঞ্জেলস চলে এলাম, আমি এই অবস্থান্তর সম্পর্কে একটা কথা বলতে চাই, আমার ছেলে আসতে চায়নি। আমার দুই সন্তান। ছেলের বয়স এখন ২১, মেয়েটার ১৬। ছেলেটা আসতে চায়নি লস আঞ্জেলসে। ও পছন্দ করত, কিন্তু ওর ইংল্যান্ডের এক প্রেমিকা ছিল। সেই ছিল আমার ছেলের জীবনের ভালবাসা, সারাহ। ও তাকে এক মাস ধরে চিনতো। আবার বলছি, ওরা ওদের সম্পর্কের ৪র্থ বার্ষিকী পালন করেছে, কারণ ১৬ বছর বয়সে এটা একটা বিশাল সময়। প্লেনের মধ্যে আমার ছেলের মন খুব খারাপ ছিল। আর ও বলছিল, “আমি আর কখনো সারাহ-র মত কাউকে খুঁজে পাবো না।” সত্যি বলতে কি, আমরা কিন্তু এসব দেখে খুশি হয়েছিলাম, কেননা মেয়েটাই আমাদের ওই দেশ ছাড়ার প্রধান কারন ছিল!
একটাজিনিস খুবই আঘাত করে যখন আপনি আমেরিকায় আসেন এবং যখন আপনি বিশ্বভ্রমনে বের হয়ঃ আপনি দেখবেন বিশ্বের সব শিক্ষাব্যবস্থাই বিভিন্ন বিষয়ে একই ক্রম মেনে চলে। প্রত্যেকটায়। আপনি যেখানেই যান না কেন। আপনি ভাববেন হয়তো অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু তা নয়। সবচেয়ে উপরে আছে গণিত আর ভাষা, তারপর মানবিক, আর সবচেয়ে নিচে শিল্পকলা। বিশ্বের সব জায়গায় এবং অধিকাংশ ব্যবস্থাতেই আবার শিল্পকলার মধ্যেও উঁচুনিচু আছে। চিত্রকলা আর সংগীতকে সাধারণত স্কুলগুলোতে উচ্চমর্যাদা দেয়া হয় নাট্যকলা আর নৃত্যের তুলনায়। এই দুনিয়ায় একটা শিক্ষাব্যাবস্থাও এমন নেই যেখানে প্রতিদিন নাচ শেখানো হয় যেমন করে আমরা প্রতিদিন অংক করাই। কেন? কেন নেই? আমি মনে করি এটাই জরুরি। আমি মনে করি, অংক খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু নৃত্যও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চারা সারাক্ষণ নাচবে যদি তাদের অনুমতি দেয়া হয়, আমরাও কিন্তু তেমনি। আমাদের সবারই দেহ আছে, তাই না? আমি কী কোথাও ভুল বললাম? সত্যি বলতে কী, শিশুরা যখন বড় হয়, আমরা তাদের কোমরের থেকে শেখাতে শুরু করি আর তারপর উপরে উঠতে উঠতে আমরা তাদের মাথার দিকে নজর দেই। তারপর হালকাভাবে একদিকে।
আপনাকে যদি এলিয়েন হিসাবে শিক্ষাক্ষেত্র ঘুরিয়ে এনে জিগ্যেস করা হত, “কিসের জন্য এই জনশিক্ষা?” আমার মনে হয় আপনি বলতেন, আপনি যদি ফলাফলের দিকে তাকান, মানে যারা সত্যিই এটার মাধ্যমে সফল; যারা যা যা করার দরকার, তার সব করে, যারা সকল সামাজিক খ্যাতি পায়, যারা বিজয়ী, আমার মনে হয় আপনাদের বলতে হবে যে পুরো বিশ্ব জুড়ে জনশিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গড়ে তোলা। তাই না? তারাই তো পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছাত্র। আমিও এরকমই একজন ছিলাম, তাই আরকি। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পছন্দ করি, কিন্তু তাদেরকে মানুষের অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উঁচুদরের হিসেবে দেখা উচিত নয়। এটা জীবনযাপনের একটা উপায় মাত্র, অন্য একটা উপায়। কিন্তু এরা জানতে বেশ আগ্রহী, তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বলছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে প্রফেসরদের মাঝে জানার আগ্রহ রয়েছে তবে সবার না, কিন্তু অধিকাংশেরই, তারা তাদের মাথার ভিতরে বসবাস করে, তারা সেখানেই বসবাস করে এবং হালকাভাবে এক দিকে হেলে। তারা সত্যিই সত্যিই বিমূর্ত, শরীরবিহীন। তারা তাদের শরীরের দিকে তাকায় আর একে তাদের মাথার বাহন হিসেবে বিবেচনা করে, তাই না? এটা তাদের মাথাকে মিটিং-এ নিয়ে যাওয়ার একটা পরিবহন। যদি “দেহ-বহির্ভূত সত্তা” অভিজ্ঞতার আসল প্রমাণ পেতে চান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা আবাসিক সভায় যান এবং সেই পার্টির শেষ রাতে নাচানাচির অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে উদয় হোন। সেখানে আপনি দেখতে পাবেন পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষেরা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অপেক্ষা করছেন পার্টি শেষ হওয়ার, যাতে তারা বাড়ি গিয়ে এটা সম্পর্কে একটা গবেষণামূলক রচনা লিখতে পারেন।
এখন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ধর্ম “প্রতিষ্ঠানিক যোগ্যতা”-র উপর ঠিক করা হয়েছে। এখানে একটা কারণ আছে। বিশ্বে এই পুরো ব্যাবস্থাটা উদ্ভাবন করা হয়েছে ১৯ শতকে। সত্যিই তার আগে কোন জনশিক্ষা ব্যাবস্থা ছিল না। এসব এসেছিল শিল্প-বিপ্লবের প্রয়োজন মেটাতে। তাই শিক্ষার ক্রমধারা দুইটি পর্যায়ে বিভক্ত হল। প্রথমত, যেসব বিষয় কাজের ক্ষেত্রে উপকারী, সেগুলো উপরের দিকে আছে। তাই আপনি যখন ছোট ছিলেন তখন আপনার কিছু ভাল লাগার বিষয়কে খুব যত্নে এড়িয়ে চলতেন, সেগুলোকে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন, এই ভয়ে যে ওগুলো নিয়ে পড়লে আপনি কখনো কোন কাজকর্ম পাবেন না। ঠিক কিনা? সংগীত চর্চা করো না, তুমি সংগীতশিল্পি হবে না; ছবি এঁক না, তুমি শিল্পী হবে না। বিনীত পরামর্শ – এখন, এটা গভীরভাবে ভুল। একটা বিপ্লব এখন পুরো বিশ্বকে গ্রাস করেছে। আর দ্বিতীয়ত হল প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা, যেটা আসলেই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতাকে দেখার ভঙ্গি বদলে ফেলছে, কারন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মত করেই ব্যবস্থাটি তৈরি করেছে। আপনারা চিন্তা করলে দেখবেন, আসলে বিশ্বে জনশিক্ষার পুরো ব্যবস্থাটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের একটা দীর্ঘায়িত ব্যবস্থা। আর তার ফল হল, অনেক উচ্চমানের মেধাবী, উজ্জ্বল, সৃষ্টিশীল মানুষ নিজেদের তা মনে করে না। কারণ তারা যে বিষয়ে ভাল ছিল, স্কুলে তার কোন মূল্য ছিল না অথবা কলঙ্কজনক ছিল এবং আমার মনে হয় এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না।
ইউনেস্কোর মতে, ইতিহাসের শুরু থেকে যত মানুষ স্নাতক করেছে, আগামী ৩০ বছরে এর সংখ্যা তার থেকেও বেশি হবে। আরো মানুষ, আর তা হল আমরা এতক্ষন যেসব নিয়ে কথা বললাম তার সমষ্টি – অর্থাৎ প্রযুক্তি আর কাজের রুপান্তরের উপর এর প্রভাব এবং জনসংখ্যা তত্ত্ব আর বিশাল জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। হঠাৎ করেই ডিগ্রী এখন মূল্যহীন। সত্যি কিনা? আমি যখন ছাত্র ছিলাম, ডিগ্রী থাকা মানেই চাকরী নিশ্চিত ছিল। তবুও কারো চাকরী না থাকা মানে ছিল সে চাকরী করতেই চায় না। আর সত্যি কথা, আমিও চাইনি। (হাসি) কিন্তু এখন ডিগ্রী থাকলেও বাচ্চারা প্রায়ই বাড়িতে ছুটে আসে ভিডিও গেম খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য, কারণ চাকরীর জন্য এম.এ. দরকার, যেখানে আগের চাকরীতে বি.এ. করলেই চলতো, আর এখন অন্যগুলোর জন্য পিএইচডি দরকার। এটা প্রতিষ্ঠানিক স্ফীতির একটা প্রক্রিয়া। এটা ইঙ্গিত করে যে শিক্ষার পুরো গঠনটা আমাদের পায়ের তলাতেই বদলে যাচ্ছে। আমাদের বুদ্ধির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে আমরা তিনটি জিনিস জানি। প্রথমত, এটা বহুমুখী। আমরা বিশ্বকে সেসব রূপে চিন্তা করি যা আমরা অভিজ্ঞতায় অনুভব করেছি। আমরা চিন্তা করি চাক্ষুষ, শব্দের মাধ্যমে, উপলব্ধির মাধ্যমে। আমরা চিন্তা করি বস্তুনিরপেক্ষ ভাবে, নড়াচড়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিবৃত্তি প্রগতিশীল (গতিময়)। গতকাল বিভিন্ন উপস্থাপনায় আমরা যা দেখলাম, আপনারা যদি মানুষের মস্তিষ্কের কার্যকলাপের দিকে খেয়াল করেন তাহলে দেখতে পাবেন বুদ্ধিবৃত্তির পারস্পরিক ক্রিয়া বিস্ময়কর। মস্তিষ্ক বিভিন্ন কামরায় বিভক্ত নয়। এমনকি, সৃজনশীলতা যাকে আমি মূল্যবান মৌলিক চিন্তা করার প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করি। দৃষ্টিভঙ্গির সৃজনশীলতা আমাদের বিভিন্ন শৃঙ্খল দ্বারা নয় বরং মনের মুক্ত কার্যকলাপ দ্বারা বিকশিত হয়।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলে রাখি, মস্তিষ্কের দুই খণ্ডকে একত্র করে “করপাস ক্যালোসাম” নামের স্নায়ু-রশ্মি। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা তুলনামুলকভাবে মোটা। এটা নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকে জেনেছি। আমার স্ত্রী হয়তো বাড়িতে রান্না করছে যেটা খুব কম হয়, ভাগ্য ভাল। কিন্তু ধরুন, সে রান্না করছে (সে কিছু জিনিসে খুব ভাল), সে ফোনে মানুষজনের সাথে কথা বলছে, সে ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলছে, সে ছাদে রঙ করছে, সে ওখানে ওপেন-হার্ট সার্জারিও করছে। আমি যদি রান্না করতে যাই, দরজা বন্ধ থাকে, বাচ্চারা বাইরে থাকে, ফোন তার জায়গায় থাকে, আমার স্ত্রী আসলে আমার বিরক্ত লাগে। আমি বলি, “টেরি, প্লিজ, আমি এখানে ডিম ভাজতে চেষ্টা করছি। আমাকে বিরক্ত কর না।
আর বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে তৃতীয়ত হল, এটা স্পষ্ট। এই মুহূর্তে আমি একটা নতুন বই লিখছি “এপিফেনী (Epiphany)”, এটা বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকারের ধারার উপর ভিত্তি করে বানানো যে তারা কিভাবে নিজেদের প্রতিভা আবিস্কার করেছেন। এই পর্যায়ে যেভাবে তারা এসেছেন, তা দেখে আমি মুগ্ধ। এটা সত্যি ঘটেছে যখন আমি একজন চমৎকার মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলাম, যার কথা হয়তো অধিকাংশ মানুষই শোনেনি, তার নাম জিলিয়ান লিন, আপনারা তার নাম শুনেছেন? কেউ কেউ হয়তো শুনেছেন। তিনি একজন নৃত্যপরিকল্পনাকারী (কোরিওগ্রাফার) এবং প্রত্যেকেই তার কাজ সম্পর্কে জানেন। তিনি “ক্যাটস্” এবং “ফ্যান্টম অব দ্য অপেরা” করেছেন, তিনি খুবই অসাধারণ। আমি ইংল্যান্ডের রয়্যাল ব্যালের পরিচালনা পর্ষদে ছিলাম আপনারা বুঝতেই পারছেন। সে যাক, জিলিয়ান আর আমি একদিন একসাথে লাঞ্চ করছি, আমি বললাম “জিলিয়ান, আপনি নৃত্যশিল্পী কিভাবে হলেন?” তিনি বললেন, এটা খুব মজার; তিনি যখন স্কুলে ছিলেন, তিনি সত্যিই খুব হতাশ ছিল। স্কুলটা ত্রিশের দশকে তার অভিভাবকের কাছে লিখেছিল, “আমাদের মনে হচ্ছে জিলিয়ানের কোন শিক্ষাজনিত অসুস্থতা আছে।” তিনি মনোযোগ দিতে পারতেন না; অস্থিরতায় ভুগতেন। মনে হয়, একাল হলে তারা বলতো তার ADHD (অতিমাত্রায় মনোযোগের অভাবজনিত রোগ) আছে। তাইনা? কিন্তু সেটা ছিল ১৯৩০ সালের দিকে, আর তখনো তো ADHD উদ্ভাবিত হয়নি। তখন সেটা খুব সুলভ অবস্থায় ছিল না। (হাসি) মানুষ জানতোই না যে তাদের এটা হতে পারে।
সে যাক, তিনি এক বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন। সেখানে ওক-কাঠের দেয়ালের ঘরে তার মা’র সাথে, তাকে শেষদিকের একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হল। তিনি সেখানে ২০ মিনিটের মত বসে রইলেন, ততক্ষন সেই লোকটা তার মায়ের সঙ্গে জিলিয়ানের স্কুল সম্পর্কিত সব সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। কারণ- তিনি লোকজনদের বিরক্ত করতেন, তার বাড়ির কাজ করতে সবসময় দেরী হত; আরও কত কী, আট বছরের ছোট শিশু- শেষে, ডাক্তারটি এসে জিলিয়ানের পাশে বসে বললেন, “জিলিয়ান, তোমার মা যা কিছু বলেছেন আমি তা শুনেছি। আর এখন তার সাথে আমার গোপনে কিছু কথা বলতে হবে।” তিনি বললেন, “এখানেই অপেক্ষা কর। আমাদের ফিরতে দেরী হবে না। বেশি সময় নেব না” তারপর তারা তাকে রেখে চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে ডাক্তারটি তার রেডিও অন করে দিল, যেটা তার ডেস্কের উপরই রাখা ছিল। ঘর থেকে বের হয়েই ডাক্তারটি তার মাকে বললেন, “শুধু দাঁড়িয়ে ওকে দেখতে থাকুন।” আর ঠিক যেই মুহূর্তে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, তিনি উঠে গিয়ে বাজনার সাথে সাথে নাচছিলেন। তারা কয়েক মিনিট ধরে এটা দেখলেন, তারপর তিনি আমার মায়ের দিকে ঘুরে বললেন, “মিসেস লিন, জিলিয়ান অসুস্থ নয়, ও একজন নৃত্যশিল্পী। ওকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন।”
আমি জিগ্যেস করলাম, “তারপর কি হল?” তিনি বললেন, “মা তাই করেছিল। আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না সেটা কত চমৎকার ছিল। আমরা একটা ঘরে হাঁটছিলাম যেটা সম্পূর্ণ আমার মত মানুষ দিয়ে ভর্তি। যারা স্থিরভাবে বসে থাকতে পারত না। যাদের চিন্তা করতে হলেই নাচতে হত।” তারা ব্যালে করতেন, ট্যাপ করতেন, জ্যাজ করতেন, আধুনিক নাচ করতেন, সমসাময়িক নাচ করতেন। এরপর, রয়্যাল ব্যালে স্কু্লে নিয়োগের জন্য তিনি পরীক্ষা দিলেন এবং একক নৃত্যশিল্পী হয়ে গেলেন। রয়্যাল ব্যালেতে তিনি চমৎকার একটা কর্মজীবন পেলেন। অবশেষে তিনি রয়্যাল ব্যালে স্কুল থেকে স্নাতক শেষ করলেন এবং নিজের কোম্পানি গঠন করলেন -দ্য জিলিয়ান লিন ড্যান্স কোম্পানি – এন্ড্রু লয়েড ওয়েবার-এর সাথে তার দেখা হল। ইতিহাসের কিছু অত্যন্ত সাফল্যময় সংগীতধর্মী নাটক সৃষ্টিতে জিলিয়ানের অবদান রয়েছে, তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন, আর তিনি একজন কোটিপতি। অন্য কেউ হলে হয়তো তাকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করাতো আর বলতো শান্ত হয়ে থাকতে।
আমি বিশ্বাস করি যে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের একমাত্র আশা হল মানুষের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা গ্রহণ করা, যেখানে আমরা মানুষের ক্ষমতার ঐশ্বর্য সম্পর্কে আমাদের ধারনাকে নতুন করে গঠন করবো। শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মনকে এমনভাবে দুর্বল করে তুলেছে যে আমরা খোলা খনি দিয়ে পৃথিবী ছেয়ে ফেলেছি, শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য। ভবিষ্যতে, এটা আমাদের কাজে আসবে না। আমরা যেই মৌলিক নীতির উপরে ভিত্তি করে শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছি তা নিয়ে আমাদের আবার চিন্তা করতে হবে। জোনাস সল্কের একটা চমৎকার বাণী হল, “যদি পৃথিবীর সব পোকামাকড় ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে বাকী সব জীবও ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি পৃথিবীর সব মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার ৫০ বছরের মধ্যে বাকী সকল প্রকারের জীব সমৃদ্ধি লাভ করবে।” এবং তিনি ঠিকই বলেছেন।
এখানে TED যা উদযাপন করছে তা হল, মানুষের কল্পনাশক্তির উপহার। আমাদের সচেতন হতে হবে যেন আমরা এই উপহারকে বিচক্ষণভাবে কাজে লাগাই আর যেসব ঘটনা সম্পর্কে এখানে জানলাম সেগুলোকে এড়াতে পারি। আর এটা করার একমাত্র উপায় হল নিজের সৃজনশীল ক্ষমতাকে এর প্রকৃত ঐশ্বর্য নিয়ে দেখা, আর সন্তানদের আমাদের আশা হিসেবে দেখা কারন ওরা সত্যিই তাই। এবং আমাদের কাজ হল তাদের সম্পূর্ণ সত্ত্বাকে শিক্ষিত করা, যাতে তারা ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে পারে- যাই হোক, আমরা আমাদের সেই ভবিষ্যতকে দেখতে না পেলেও, ওরা পারবে। আমাদের কর্তব্য হল সেখান থেকে কিছু গঠন করতে ওদের সাহায্য করা। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।