মানুষ আইডিয়া নিয়ে জন্মায় না
- লিডারশিপ ডেস্ক
২৫ নভেম্বর চলে গেছেন কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো। কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার পর দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এসকোয়ার ম্যাগাজিনে পৃথিবীর দিকপালদের বলা কথার নির্যাস থেকে যে লেখা প্রকাশিত হয়, তাতে মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর জীবনদর্শন। এ লেখাতেও উঠে এসেছে কিউবা বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ভাবনার জগৎ।
আমার নাম ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবাকে মুক্ত করার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে।
আমি যা বলছি, তা সবাই মেনে নেবে, তা নয়। কিন্তু আমি যা ভাবি, সেটাই বলি এবং বলি অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই।
আমি গরিব ঘরে জন্মাইনি। আমার বাবার ছিল কয়েক হাজার একর জমি। জনাব বুশের খোঁচা দেওয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, এখন আমার পকেটে একটা ডলারও নেই। আমার সব সম্পদ এখন তাঁর মাড় দেওয়া শার্টের পকেটে। কখনো যদি এমন উপলক্ষ আসে, যখন আমার সব সম্পদ এক করতে হবে, যদি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, তাহলে আমি বুশের ওই ম্যাজিক পকেট থেকে ধার নেব। আর যদি মিস্টার বুশের মনে হয়, আমার সম্পদের পরিমাণ খুব বেশি, তাহলে আমি আগেই আমার সব সম্পদ তাঁকে দিয়ে দেব—তাঁর পকেট ভাড়া নিয়ে।
আমার মনে পড়ে, যখন আমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনের ছাত্র, যখন আমার বয়স ১২ কী ১৩, তখন যে গ্রামে আমি জন্মেছিলাম, সে গ্রামে পৌঁছাতে হতো শুধু ঘোড়সওয়ার হয়ে। রাস্তাটা ছিল আবর্জনা আর ধূলিমলিন। সে সময় ছেলে আর মেয়েদের স্কুল ছিল আলাদা। ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে যোজন যোজন দূরে থাকত। এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য ছিল কষ্টকর।
বিপ্লব শুরু করার সময় আমরা ছিলাম ৮২ জন। যদি আবার কখনো বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তবে এখন ১৫ জন, এমনকি ১০ জন বিপ্লবী হলেই চলবে। ১০ জন মানুষ এবং সত্যিকার বিশ্বাস। সেটা থাকলে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। দরকার বিশ্বাস এবং দরকার নিখুঁত পরিকল্পনা।
আমি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি এই বিশ্বাস নিয়েই থাকতে চাই।
ধনী রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্রাগারে যে অস্ত্র আছে, তা দিয়ে নিঃস্ব, অশিক্ষিত, অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত মানুষকে হত্যা করা যায়। কিন্তু তা অসুখ, ক্ষুধা আর অহংকারকে হত্যা করতে পারে না।
এখন মানবসভ্যতাকে বাঁচানো দরকার। কিন্তু তরুণেরা যদি ঠিক পথে না এগোয়, তবে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে।
পুঁজিবাদ একটা রোগ। এই রোগ যুদ্ধ, মিথ্যা আর প্রতিযোগিতাকে সামনে নিয়ে আসে।
আমি সারা জীবন নিজেকে একজন সুখী মানুষ হিসেবেই দেখেছি। এর কারণ মনে হয় এই, আমি ঠিক রাজনৈতিক ভাবনাটাকে পেয়েছি, কিউবার রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেছি এবং মার্ক্সবাদে মুক্তির পথ দেখেছি। এটা অনেকটা এ রকম, জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলার পর হঠাৎ করেই হাতে মানচিত্র চলে আসা।
কিউবা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুল করবে যদি কিউবাকে সমানে সমান না ভেবে অন্য কিছু ভাবে।
আমার দেশটাকে আমি স্বর্গ বলে মানি। আমি বারবার বলেছি, আমরা নরকে বাস না করে এই স্বর্গেই মরতে চাই।
বিপ্লব গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো বিছানা নয়। এটা জীবনের জন্য সংগ্রাম নয়, এটা অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে মৃত্যু।
দর্শনের জন্য অস্ত্রের সাহায্য দরকার হয় না, যদি মানুষের সহযোগিতা থাকে।
তুমি বলো কোন খেলা তোমরা খেলো, আমি বলে দেব তোমরা কাদের উপনিবেশে ছিলে।
দেশ হলো মানবসভ্যতা।
যদি মনে হয়, জীবন দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়ছে, হৃদয় থেকে যে আগুন বের হয় তা দুর্বল হয়ে কাঁপছে, তাহলে আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই।
আমি এখন অসুস্থ, আমাকে নানা রকম প্রশ্ন করা হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, ক্ষমতা থেকে সরে গেলে আমি কী নিয়ে থাকব? আমি তখনো অবসরহীনভাবে সংগ্রাম করে যাব, যা করে এসেছি সারাটা জীবন।
আমি এখন সেই কাজটাই করছি, যেটা বুড়ো বয়সে সবাই করে—ভাবি আর লিখি। আমার অনেক কাজই অসমাপ্ত হয়ে রইল। চলচ্চিত্র ও ছবির জন্য আমার সময় নেই, দাড়ি-গোঁফ কাটার মতো সময় নেই, প্রতিদিন আনন্দে থাকার সময় নেই। বুড়ো বয়সে এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
আমি চেষ্টা করি আমার কথা সংক্ষেপ করতে। মিডিয়ায় বা টেলিভিশনে তা যেন বেশি জায়গা না নেয়। যে বিষয়ে অনেক সমালোচনা করা দরকার, তার সব আমি বলতে পারি না। সেসব বললে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হবে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় না রাখলে তা আমার দেশের জন্য খারাপ হবে। কিন্তু আমি সব সময় বিশ্বাস করি, কখনো মিথ্যা লেখো না।
মানুষের জন্মের সময় সে আইডিয়া নিয়ে জন্মায় না, মরার সময়ও আইডিয়া নিয়ে মরে না।
প্রতিদিনকার সংগ্রামের মধ্যে কখনো কখনো আমি বিশ্রাম নিই।
জ্ঞানের চেয়ে অনুভব বেশি দামি।