কী শিখবেন, কীভাবে শিখবেন ?
- লিডারশিপ ডেস্ক
গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই। ২৩ বছর পর নিজের ক্যাম্পাস, ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) খড়গপুরে পা রেখেছিলেন তিনি। স্মরণ করেছেন তাঁর ছাত্রজীবনের কথা।
আমার মনে আছে, কলেজ ছেড়ে যাওয়ার সময় যখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, খুব মন খারাপ লাগছিল। কী দারুণ চারটা বছর কেটেছে এখানে! এরপর গত ২৩ বছরে আর আসা হয়নি। আজ সত্যিই ভীষণ স্মৃতিকাতর লাগছে।
তখন ভাবিনি, এত বছর পর আবারও ফিরব এই মুক্তমঞ্চে কথা বলার জন্য। হাজারো ছাত্রছাত্রী আমার কথা শুনবে। আমি তো একজন সাধারণ ছাত্রই ছিলাম। আর দশজন ছাত্রের মতোই কখনো কখনো ক্লাস ফাঁকিও দিয়েছি। কলেজে তখন ‘র্যাগিং’ সেভাবে ছিল না। কিন্তু আমাদের সময় ‘সিজি চেঞ্জ’ বলে একটা কথা ছিল। এখনো কি আছে? সিজি চেঞ্জ মানে হলো ‘সেন্ট্রাল গ্র্যাভিটি চেঞ্জ’। একবার রুমের দরজায় তালা দিয়ে কোথায় যেন গেছি। ফিরে এসে দরজা খুলেই চমকে গেলাম। জামাকাপড়-বই থেকে শুরু করে টেবিল, খাট—সব কিছুর জায়গা বদলে গেছে! অথচ দরজায় তালা ছিল ঠিকই। আসলে বাইরে থেকে লাঠি দিয়ে ঘরের সব ওলট-পালট করে দেওয়া হয়েছিল। নবাগত ছাত্রদের চমকে দিতে সিনিয়ররা এই কাজ করতেন। এরই নাম দেওয়া হয়েছিল সেন্ট্রাল গ্র্যাভিটি চেঞ্জ।
আমি চেন্নাই থেকে এসেছিলাম। স্কুলে হিন্দি শিখেছি, কিন্তু খুব একটা বলতে পারতাম না। এখানে এসে সহপাঠীদের কথা শুনে একটু একটু করে শিখছিলাম। মনে আছে একবার অপরিচিত এক লোককে আমি ‘আব্বে সালেহ…’ (অ্যাই শালা) বলে ডেকেছিলাম। বন্ধুদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, এভাবেই বোধ হয় মানুষকে সম্বোধন করতে হয়!
অঞ্জলি ছিল আমার সহপাঠী। এখন যদিও সে আমার স্ত্রী। ক্লাসেই ওর সঙ্গে পরিচয়। তখন এসএন হল ছিল মেয়েদের একমাত্র হোস্টেল। মেয়েদের হোস্টেলে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা আরেক বিব্রতকর অভিজ্ঞতা। আমি হয়তো কাউকে ডেকে নিচু গলায় বললাম, ‘অঞ্জলিকে একটু ডেকে দেবেন?’ তিনি ভেতরে গিয়ে চিৎকার করে পুরো হোস্টেল জানান দিতেন, ‘অঞ্জলি, তোমার সঙ্গে দেখা করতে সুন্দর এসেছে।’
আমি জানি না কেন, আজ আমার হলের সেই সরু করিডর থেকে শুরু করে নিজের ছোট্ট কামড়াটাও দেখতে একই রকম লাগল। অথচ সব কত বদলে গেছে। আমি যখন এই ক্যাম্পাসে ছিলাম, তখন গুগল ছিল না। ইন্টারনেটও ছিল না।
গুগলে আমরা চেষ্টা করি এমন কিছু তৈরি করতে, যেটা কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করবে। এবং যা তাদের জীবনের কোনো না কোনো সমস্যার সমাধান দেবে। যেকোনো কিছু তৈরি করার সময় এটাই থাকে আমাদের লক্ষ্য। আমরা লক্ষ্যটা এত বড় রাখি যেন দু-একবার ব্যর্থ হওয়াটা স্বাভাবিক মনে হয়। ল্যারি (গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ) বলে, ‘যদি তুমি খুব কঠিন কিছু নিয়ে কাজ কর, যা আর কেউ করছে না, চালিয়ে যাও। কারণ তোমার কোনো প্রতিযোগী নেই। তুমি যদি ব্যর্থও হও, নিশ্চয়ই একটা ভালো কিছু পাবে।’
গুগলে আমি ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম ২০০৪ সালের পয়লা এপ্রিলে। তখন তারা মাত্রই জিমেইল চালু করেছে। আমি তখনো জিমেইল সম্পর্কে জানতাম না। ইন্টারভিউতে ওরা যখন আমাকে জিমেইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল, প্রথমে ভেবেছিলাম এটা একটা ‘এপ্রিল ফুল জোক’! মনে আছে ইন্টারভিউয়ের মাঝখানে একজন আমাকে আইসক্রিম খেতে দিয়েছিল। সেদিনই বুঝেছিলাম, এই প্রতিষ্ঠানটা অন্যরকম। এখানে আমি অসাধারণ সব মানুষের সঙ্গে কাজ করি। একটা ঘরে যখন অস্বাভাবিক মেধাবী মানুষেরা তোমাকে ঘিরে থাকবে, তখন একটা সমস্যা হওয়া খুব স্বাভাবিক। আমরা এটাকে বলি ‘ইম্পোস্টার সিনড্রোম’। এসব ক্ষেত্রে মনে হয়, আমি বোধ হয় এই রুমে থাকার যোগ্য না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা ক্লাসরুমে অনেক শিক্ষার্থীরও এ সমস্যা হয়। আমি বলব, অন্যের দিকে মন না দিয়ে নিজের কাজটার প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বা পড়ালেখার ধরনটাও নিশ্চয়ই বদলানো উচিত। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, এখানে পাঠ্যবইয়ের পেছনে সময় দেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের পৃথিবীতে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। সেখানে কাজের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বেশি। তাই বিভিন্ন ধরনের কাজ করো। ঝুঁকি নাও। খোঁজো, কোন কাজটা তুমি ভালোবাসো। সেটাই মন লাগিয়ে করো। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ ছাত্র তাদের মেজর ঠিক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে উঠে। কারণ এর আগে পর্যন্ত তারা তাদের আগ্রহের বিষয়টা অনুসন্ধান করে। একাডেমিক পড়ালেখাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ততটা নয়, যতটা গুরুত্ব আমরা দিই। জীবন একটা দীর্ঘ যাত্রা। তাই আমি যা করছি, তা উপভোগ করা খুব জরুরি।
গুগলে আমাদের ৬০ হাজার কর্মী আছেন। এই কর্মীদের মধ্যে ছোট ছোট দল আছে। সেসব দলের নেতা আছেন। পুরো প্রতিষ্ঠানের নেতা হিসেবে আমার কাজ হলো, অন্য নেতাদের সামনে থেকে বাধাগুলো সরিয়ে দেওয়া। তাঁদের বিশ্বাস করা, স্বাধীনতা দেওয়া, তাঁদের সফল করা। আমি বিশ্বাস করি—নেতৃত্ব দেওয়া মানে নিজে সফল হওয়া নয়। বরং এটা নিশ্চিত করা যে আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা সফল হচ্ছেন।
এখনকার পড়ালেখায় চাপ খুব বেশি। আমার খুব অবাক লাগে, ক্লাস এইট থেকেই নাকি শিক্ষার্থীরা আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। কিন্তু এটা বুঝতে হবে, পড়ে শেখার চেয়ে করে শেখা জরুরি। ব্যর্থতা কোনো বাধা না। অনেকে বলে, ‘তুমি অমুক কলেজে ভর্তি হতে পারোনি, ব্যাস, তোমার জীবন তো এখানেই শেষ।’ এমনটা কখনোই না। আশা আর স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখে সেটা অনুসরণ করতে পারাটাই বড়।