একটাই ‘এ’ গ্রেড পেয়েছিলাম : কেট উইন্সলেট
- লিডারশিপ ডেস্ক
টাইটানিক খ্যাত অভিনয়শিল্পী কেট উইন্সলেট। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কার ভরেছেন ঝুলিতে। বয়স ৪০ ছাড়িয়েছে, এখনো তিনি ঝলমলে তরুণ। ফেসবুকভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন উই ডের আয়োজনে গত ২২ মার্চ লন্ডনে বক্তব্য দিয়েছেন এই অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পী। বলেছেন তাঁর লড়াইয়ের গল্প।
আমি কেট উইন্সলেট। বার্কশেয়রের রেডিংয়ে আমার জন্ম। আমরা তিন বোন, এক ভাই। মা ছিলেন দারুণ রাঁধুনি। তাঁর আরেকটা গুণ, তিনি চমৎকার গল্প বলতে পারতেন। বাবা ছিলেন একজন পোস্টম্যান, একজন ভ্যানচালক, একজন ক্রিসমাস ট্রি বিক্রেতা, আরও বিচিত্র ধরনের কাজ তিনি করেছেন। আর হ্যাঁ, তিনি একজন অভিনয়শিল্পীও ছিলেন। অভিনয় তাঁর পকেটে কিছু যোগ করেনি, তবু কাজটা তিনি ভালোবাসতেন। এই শিল্পের প্রতি আমার ঝোঁক সম্ভবত তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। স্কুলে গণিত, ইংরেজি, ইতিহাস…কোনো বিষয়ই আমার ভালো লাগত না। আমার ভালো লাগত নাটক। সমস্ত আবেগ ছিল নাটক ঘিরে।
স্কুলের নাটকে আমি কখনোই তেমন ভালো কোনো চরিত্র পাইনি। পরির চরিত্র, কুমিরের চরিত্র এমনকি কাকতাড়ুয়ার চরিত্রেও সানন্দে অভিনয় করেছি। চরিত্রটা ছোট হোক, বড় হোক, সব সময় নিজের সেরাটা দিতে চেষ্টা করেছি। বাবা বলতেন, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। অতএব পরিশ্রম অব্যাহত রাখো। আমি যথাসাধ্য সেই চেষ্টাই করেছি। ফলাফলও পেয়েছি। স্কুলে একমাত্র নাটকের ক্লাসেই আমি ‘এ’ পেয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমার স্কুলজীবনে এই একটাই ‘এ’ গ্রেড ছিল।
কিন্তু আজ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস আমি কোথায় পেলাম? সত্যি বলছি, সিনেমায় অভিনয় করার সাহসও আমার ছিল না। তাহলে এত দূর পথ কীভাবে পাড়ি দিলাম? বলছি।
স্কুলে পড়ার সময় মায়ের সঙ্গে স্যান্ডউইচের দোকানে কাজ করা শুরু করেছিলাম। অতএব যেখানেই কোনো ‘অডিশন’-এর খবর পেতাম, সেখানেই ছুটে যাওয়ার মতো হাতখরচ উপার্জনের একটা পথ হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি শুধু অডিশন দিয়েই যাচ্ছিলাম, কোনো চরিত্রেই কাজের সুযোগ হচ্ছিল না। আমি সব সময় নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতাম। স্কুলে সবাই আমাকে ‘ভোটকু’ বলে খ্যাপাতো। অভিনয় করতে চাইতাম বলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, জ্বালাতন করত। মনে আছে, একবার আমাকে স্কুলের আলমারির ভেতর আটকে রেখে সবাই হো হো করে হাসছিল। আমি সুন্দরী ছিলাম না। ‘তোমার সৌভাগ্য যে মোটা মেয়েদের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছ।’ এমন কথাও শুনতে হয়েছে। আর বারবার শুনতে হয়েছে একটি বাক্য,‘আমরা যা খুঁজছি, তুমি তা নও, কেট।’
মানুষের নির্দয়তা দেখে ভীষণ অসহায় লাগত। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, আমি অসুন্দরী। অন্যের দেওয়া ‘সুন্দর’-এর সংজ্ঞার সঙ্গে আমি খাপ খাই না, এই ব্যর্থতা আমাকে কষ্ট দিত। অতএব আমি ভয় পেতে শুরু করলাম। ধরে নিলাম, অভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু এটাই তো আমার আবেগের জায়গা! নিজেকে নিজে বললাম, আমি অভিনয়ই করতে চাই! অভিনয় আমাকে আনন্দ দেয়। যে আনন্দ নিজেই নিজেকে উপহার দিয়েছি, সেটা তো অন্য কেউ কেড়ে নিতে পারে না। অন্যের কথায় তো আমি আমার স্বপ্ন বিসর্জন দেব না।
তো আমি কী করলাম?
হাল ছাড়লাম না। লড়াই চালিয়ে গেলাম।
লোকের বাজে মন্তব্য আমি অগ্রাহ্য করেছি। বিশ্বাস করেছি নিজেকে। আমাকে এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ভাবতে হয়েছে, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ভালোবাসার জিনিসটা পেতে হলে গোঁয়ার হতে হয়। বিশ্বাস করতে হয়, আমি এটার যোগ্য। কখনো কখনো এই বিশ্বাস করাটাই সবচেয়ে কঠিন।
একদিন একটা অডিশনে হাজির হয়েছি। চুলটা ভালো না, পা-গুলো বেশি বড়, শরীরের গঠনটা মিলছে না…এসব যুক্তিতে অডিশনে একের পর এক মেয়েরা বাদ পড়ছিল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম লাইনের সবচেয়ে পেছনে। কিন্তু নির্বাচকদের সামনে যখন দাঁড়িয়েছি, তখন আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল। তারা বলেছিলেন, ‘কেট, তুমি কি প্রস্তুত?’ আর আমি বলেছিলাম, ‘আপনারা আমাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত তো!’
হ্যাঁ, আমি মনে মনে বলেছিলাম, ‘হে পৃথিবী, আমাকে গ্রহণ করতে তুমি কি প্রস্তুত?’ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আর এভাবেই একদিন…একদিন রেডিং শহরের স্যান্ডউইচের দোকানে কাজ করা মেয়েটি, সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত প্রার্থীটি কিনা ডাক পেল টাইটানিক ছবির রোজ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য! ভাবতে পারেন, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি এটি!
আপনি যেখান থেকেই আসেন না কেন, আপনি যেকোনো কিছু করতে পারবেন। বিশ্বাস করুন। ভয়কে জয় করা সম্ভব। যদি আমি হেরে যাই, লোকে কী বলবে…এসবের তোয়াক্কা করবেন না। আপনি ‘আপনি’ হয়েই অন্যের সামনে দাঁড়ান। অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করা বন্ধ করুন। আপনি যা, আপনি তা-ই।
ঠিক এ কাজটাই আমি করেছিলাম। ওরা যখন বলেছে, এই চরিত্রের সঙ্গে তোমাকে মানায় না। আমি বলেছি, তাতে কী? আমি এমনই। এটাই আমি। আমি, কেট উইন্সলেট!