তোমাদের জন্য হেলেনের ৫ পরামর্শ
- লিডারশিপ ডেস্ক
বয়স সত্তর পেরিয়েছে। অথচ এখনো কী দারুণ তাঁর রসবোধ! যুক্তরাজ্যের অভিনয়শিল্পী হেলেন মিরেন। দ্য কুইন ছবিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চরিত্রে অভিনয় করে অস্কারসহ একাধিক পুরস্কার বগলদাবা করেছিলেন। কমেডি থেকে শুরু করে ধুন্ধুমার অ্যাকশন—সব ধরনের ছবিতেই তিনি সপ্রতিভ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টুলেইন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় হেলেন প্রাণ খুলে হেসেছেন, হাসিয়েছেন শ্রোতাদের।
শিক্ষার্থীরা, অবশেষে তোমরা পেরেছ! ক্লাস, প্রবন্ধ, আলোচনা, লেকচার, কম্পিউটারের সঙ্গে একেকটা বিনিদ্র রাত…সব পেরিয়ে তোমরা আজকের দিনে পৌঁছেছ। সব শেষে আর একটা মাত্র মানুষের কথা তোমাদের শুনতে হবে, সেই মানুষটা আমি। চেষ্টা করব আমার বক্তব্যটা যেন ‘লেকচার’ হয়ে না যায়। ভয় নেই, তোমাদের সামনে কথা বলব বলে ‘হোমওয়ার্ক’ করেই আমি এসেছি।
প্রতিটি চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমি রীতিমতো গবেষণা করি। চরিত্রটি ভালোমতো বুঝে নিই। রেড ছবিতে সিক্রেট এজেন্টের চরিত্রের জন্য যেমন গুলি চালানো শিখেছিলাম। রানির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শিখেছি, কীভাবে তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আর টিচিং মিসেস টিঙ্গেল ছবিতে একজন বাজে শিক্ষকের চরিত্র রপ্ত করার জন্য গিয়েছিলাম এলএসইউতে কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরাই সব শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
তা আজকের দিনের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিলাম? গবেষণা করে দেখলাম, একজন সমাবর্তন বক্তার কাছ থেকে শ্রোতারা আসলে কী শুনতে চায়। হাজারো পরামর্শ পাওয়া গেল, তবে মূল কথা মাত্র তিনটি।
প্রথমত, বক্তব্য ছোট রাখা। আধঘণ্টার লম্বা বক্তৃতা কেউ শুনতে চায় না। অতএব আমি বরং এখানেই শেষ করি, খাবার টেবিলে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে…(হাসি)।
দ্বিতীয়ত, তোমার জীবনের গল্পটা এমনভাবে বলবে, যেন শ্রোতারা নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়। দুর্ভাগ্যবশত আজকের সমাবর্তন বক্তার সঙ্গে শুধু সে-ই নিজের মিল খুঁজে পাবে—যে শেক্সপিয়ারের গল্পের নায়িকা হতে চেয়েছিল—অথচ তাঁকে কিনা ১০টি চলচ্চিত্রে নিরাভরণ দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছে। তোমাদের বাবাদের মধ্যে কেউ পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে গুগলে আমার নাম লিখে ‘সার্চ’ করা শুরু করেন কি না, সেটা পরীক্ষা করার জন্যই এ কথা বললাম! বাবারা, থামুন।
তৃতীয়ত, সমাবর্তন বক্তার এমন একটা কথা বলা উচিত, যাতে শ্রোতারা তাঁর কথাটা অন্তত ৪০ বছর মনে রাখে। অনেক ভেবেচিন্তে এমন একটা কথা আমি খুঁজে পেয়েছি। আশা করি ২০৫৭ সাল পর্যন্ত এটা তোমাদের মনে থাকবে। কথাটা হলো—ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার কিংবা ওভাল অফিস, যেখানেই তুমি থাকো না কেন, রাত তিনটার সময় টুইট করাটা কোনো কাজের কথা না! (মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইট নিয়ে রসিকতা করে এ কথা বলেন হেলেন। বি. স.)
রাত তিনটা প্রসঙ্গে মনে পড়ল, নিউ অরলিন্সে ফিরে আসতে পেরে সত্যিই ভালো লাগছে। এখানে আমি কখনোই রাত তিনটার আগে ঘুমাতে পারিনি। গত কয়েক দিন এই ক্যাম্পাসের আনাচ-কানাচে ঘুরে তোমাদের জন্য একটা প্রশ্নই আমার মাথায় এসেছে—কোন দুঃখে তোমারা স্নাতক সম্পন্ন করছ? এত সুন্দর একটা জায়গা ফেলে বাইরে গিয়ে চাকরিবাকরি খোঁজার কী দরকার আমি বুঝি না! এখনো দেরি হয়ে যায়নি। ডিনকে বলো, তোমার ডিগ্রিটা রেখে দিতে, আর নিজের ডর্মে ফিরে যাও!
জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে আমি যা শিখেছি, সেসবের মধ্য থেকে কিছু কথা আমি তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। তোমরা একে বলতে পারো, সুখী জীবনের জন্য হেলেনের পাঁচ পরামর্শ।
প্রথম পরামর্শ: বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ো না। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে আমি টেইলরকে বিয়ে করেছি এবং এর সুফল পাচ্ছি। সব সময় তোমরা তোমাদের জীবনসঙ্গীকে তাঁর জীবনের লক্ষ্যটা পূরণ করতে সাহায্য কোরো।
দ্বিতীয় পরামর্শ: মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখো। অনেক অনেক দিন আগে আমার এক অভিনেত্রী বন্ধু খুব সহজ কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমাকে শিখিয়েছিল। আমার বন্ধুটি ধূমপান করত। আমরা একসঙ্গে ট্যাক্সিতে করে শুটিংয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে ধূমপান করার ব্যাপারে সেই সময় কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তো আমার বন্ধু একটা সিগারেট ধরাল এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়ির চালককেও একটা সিগারেট সাধল। খুব সাধারণ একটা কাজ। কিন্তু ভেবে দেখ। সে কিন্তু গাড়ির চালককে ‘গাড়িচালক’ ভাবেনি, ‘মানুষ’ ভেবেছে। আজকের দিনে এ কাজ করলে হয়তো ‘হত্যাপ্রচেষ্টার’ অভিযোগে ওর জেল হয়ে যেত! কিন্তু এই শিক্ষাটার জন্য আমি আমার বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ। ঘটনাটা আমি কখনো ভুলব না। অতএব মনে রাখবে—তোমার ওপর কারও আধিপত্য থাক বা না থাক, সমপরিমাণ সম্মান ও বিনয় প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য।
দ্বিতীয় পরামর্শটির সঙ্গে আরেকটি কথা যোগ করতে চাই। তুমি যে জেন্ডারেরই হও না কেন, নারীবাদী হও। বহু দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ আমি দেখেছি। সুইডেন থেকে উগান্ডা, সিঙ্গাপুর থেকে মালি—সব জায়গার ক্ষেত্রেই একটি কথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত—নারী যদি তাঁর প্রাপ্য সম্মান বুঝে পান, তাহলে পুরো জাতিই তার সুফল ভোগ করে।
তৃতীয় পরামর্শ: তুমি দেখতে কেমন, তার ওপর নির্ভর করে কেউ যদি তোমাকে বিচার করে, তাকে পাত্তা দিয়ো না। বিশেষ করে সে যদি মনিটরের পেছনে লুকিয়ে থাকা কোনো চরিত্র হয়। আর তুমি নিজেই যদি একজন মনিটরের পেছনে মুখ লুকিয়ে রাখা ইন্টারনেটে আসক্ত মানুষ হও—বন্ধ করো! স্রেফ বন্ধ করো। বাইরে গিয়ে অন্তত একটা কাজের কাজ করো।
চতুর্থ পরামর্শ: ভয়কে ভয় পেয়ো না। এটা ঠিক, কখনো কখনো ভয় পাওয়াটাই উচিত। অল্প পানির একটা পুলে লাফ দেওয়ার আগে ভয় পাওয়াই শ্রেয়। এসব ক্ষেত্রে বেশি করে ভয় পাও; এত বেশি যে ভয়ে যেন কাজটা তুমি না-ই করো। কিন্তু ‘আমি কি পারব? আমি কি যথেষ্ট বুদ্ধিমান? আমি হেরে যাব না তো?’—এইসব ভয়ের দিকে সোজাসুজি এগিয়ে যাও। একবার ভয়টা উতরে গেলেই চিরতরে সেটিকে লাথি মেরে উড়িয়ে দাও।
পঞ্চম পরামর্শ: এবার আসি ‘হেলেনের সুখী হওয়ার পরামর্শ’ নম্বর পাঁচে। জীবনটাকে অতি জটিল কোরো না। কী করব, আর কী করব না—খুব স্বাভাবিক কিছু নিয়ম মেনে চললেই পথটা সহজ।
কাজে গড়িমসি কোরো না।
তোমার রসবোধ হারিয়ো না।
তোমাকে যারা উত্ত্যক্ত করে, তাদের মুখোমুখি দাঁড়াও।
ভালোবাসো।
ভালোবাসা আর যৌনতাকে গুলিয়ে ফেলো না। কেননা ভালোবাসা সাধারণত দুই মিনিটের বেশি টেকে!
এমন আরও অনেক ‘করো’ এবং ‘কোরো না’-এর কথা আমার বলা উচিত ছিল। কিন্তু আমি আসলে আজ সকালে শেষ মুহূর্তে এ তালিকাটা তৈরি করেছি।
আর হ্যাঁ, আরেকটি কথা—প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার তোমার মা-বাবাকে ফোন কোরো। ফোন করে বোলো, তুমি তাঁদের ভালোবাসো। টাকা চাওয়ার প্রসঙ্গটা না হয় এরপর আসুক!
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে, তারুণ্যের উজ্জ্বল ও বিভ্রান্তিকর সময়টাতে আমি বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। মায়া সভ্যতার বিদ্যা থেকে আমি প্রচণ্ড অনুপ্রেরণাদায়ক একটি কথা শিখেছি। কথাটি আমি আমার বাঁ হাতে ট্যাটু করে রেখেছি।
খুব সহজ একটি প্রবাদ—‘ইনলাকেশ’।
এর অর্থ হলো, ‘তুমিই আমি। আমিই তুমি। আমরা এক।’
আমি যদি তুমি হই, তাহলে তোমার প্রতি আমার কিছু দায়িত্ব আছে। আবার তুমি যদি আমি হও, তাহলে আমার প্রতিও তোমার কিছু দায়িত্ব আছে। ‘এখানে আমরা সবাই এক’—এ কথাটাই মায়ানরা আরও সুন্দর ভাষায় বলতে চেয়েছেন।
হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই একসঙ্গে আছি, কথাটি মনে রেখো। যেন খ্যাপাটে পৃথিবীটাকে তোমরা পথ দেখাতে পারো।