ভবিষ্যতের ‘আপনি’ গড়বেন একটা ভালোবাসাময় পৃথিবী
- লিডারশিপ ডেস্ক
শাহরুখ খান সব সময়ই প্রাসঙ্গিক, সব সময় তিনি আলোচনায় আছেন। গত এপ্রিলে কানাডার ভ্যানকুভারে টেড টকের আয়োজনে বক্তৃতা করেছিলেন বলিউডের বাদশাহ। শ্রোতাদের অধিকাংশের কাছেই তিনি পরিচিত নন। তবু স্বভাবসুলভ হাস্যরস আর কথার জাদুতে মন জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। পড়ুন নয়াদিল্লির শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া এক তারকার গল্প।
আমি সিনেমার একজন তারকা। আমার বয়স ৫১ এবং আমি এখনো বটক্স (মুখের ভাঁজ দূর করতে সহায়ক একধরনের ওষুধ) ব্যবহার করি না। পর্দায় আমি ২১ বছর বয়সী তরুণের মতো আচরণ করি। এমনটা আমাকে করতে হয়। আমি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। আমি ভালোবাসা ফেরি করি ভারতের সেই লাখো মানুষের কাছে, যাঁরা আমাকে ভাবে বিশ্বের সেরা প্রেমিক।
যদি ব্যাপারটা গোপন রাখার নিশ্চয়তা দেন তো চুপি চুপি বলি, তাঁদের ধারণা সঠিক নয়! তবে আমি তাঁদের এই ভুল ভাঙাতে চাই না। এখানে অনেকেই আছেন, যাঁরা আমার কোনো কাজ দেখেননি। আপনাদের জন্য দুঃখ হচ্ছে (হাসি)।
বুঝতেই পারছেন, আমিও অন্যান্য চিত্রতারকার মতো আত্মপ্রচারণায় বিশ্বাসী। তাই আমার বন্ধু ক্রিস ও জুলিয়েট যখন বলল, এখানে ‘ভবিষ্যৎ-আপনি’ বিষয়ে আমাকে কথা বলতে হবে, স্বাভাবিকভাবেই আমি আগে ‘বর্তমান-আমি’ নিয়ে কিছু কথা বলব। কারণ, আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, মানবিকতা ব্যাপারটা অনেকটা আমার মতো। হ্যাঁ, সত্যিই তা-ই। মানবিকতা হলো বার্ধক্যের দিকে এগোতে থাকা এক চিত্রতারকার মতো। নতুনকে আঁকড়ে ধরতে ব্যাকুল, নিজের উন্নয়ন নিয়ে খুবই সচেতন এবং ঝলমলে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটা শরণার্থী শিবিরে আমার জন্ম। বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মা-ও অবশ্যই একজন যোদ্ধা বটে, অন্য মায়েদের মতোই। আর দশটা মানুষের মতো আমাদেরও বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে। একেবারে তরুণ বয়সে মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছি। আমার এই অগোছালো জীবনের পেছনে এটাও একটা কারণ।
বাবা মারা যাওয়ার সেই রাতটা আমার মনে পড়ে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন আমাদের এক প্রতিবেশীর ড্রাইভার। ‘মরা মানুষ ভালো বকশিশ দেয় না’ এমন একটা কিছু বিড়বিড় করে বলেন, গাড়িতে আমাদের ফেলে রেখে তিনি চলে গিয়েছিলেন। আমার বয়স তখন মাত্র ১৪। বাবার মৃতদেহ গাড়ির পেছনের সিটে রেখে, মাকে পাশে বসিয়ে স্টিয়ারিং আমাকেই ধরতে হলো। নিঃশব্দ কান্নার ফাঁকে মা বলেছিলেন, ‘বেটা, তুমি গাড়ি চালানো শিখলে কবে?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘মাত্রই শিখলাম, মা!’ অতএব, খুব ছোটবেলায়ই বেঁচে থাকার কঠিন যুদ্ধের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল…
চল্লিশ পেরোনোর পর আমি রীতিমতো উড়তে শুরু করলাম। তত দিনে সারা বিশ্ব চষে বেরিয়েছি। ৫০টা ছবি এবং ২০০ গানে অংশ নিয়েছি। মালয়েশিয়া থেকে নাইট সম্মাননা পেয়েছি। ফরাসি সরকার আমাকে তাদের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা দিয়েছে…সেই সম্মাননার নাম অবশ্য আমি এখনো উচ্চারণ করতে পারি না। দুঃখিত ফ্রান্স। এবং ধন্যবাদ।
তবে আমার জীবনে এর চেয়েও বড় পাওয়া হলো অ্যাঞ্জেলিনা জোলির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ…যদিও সেটা আড়াই সেকেন্ডের জন্য। আড়াই সেকেন্ডের সেই সাক্ষাতের কথা নিশ্চয়ই তিনিও স্মরণ করেন। হানা মন্টানার (মাইলি সাইরাস) সঙ্গে একই গোলটেবিলে বসে রাতের খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তবে বেশির ভাগ সময় তিনি আমার দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিলেন। মাইলি থেকে শুরু করে জোলি অবধি আমি স্রেফ উড়েছি…
ভারতের মানুষ আমাকে তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন। তাঁদের কাছেই আমি শিখেছি, ক্ষমতা কিংবা দারিদ্র্য কোনোটাই আপনার জীবনে জাদুর ছোঁয়া দেবে না, আপনার জীবনের জটিলতা কমাবে না। মানব ইতিহাসের সেই পুরোনো অনুভূতি: ‘ভালোবাসা’ থেকেই মানুষ নতুন কিছু করার, পতন থেকে উঠে দাঁড়ানোর আর বাঁচার শক্তি পায়। আমার দেশের এক কবি বলেছেন, যত বই-ই আপনি পড়েন না কেন; সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন আর প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যত জ্ঞানই অর্জন করেন না কেন, আপনার জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যদি না মানুষে মানুষে ভালোবাসা তৈরি হয়। দুটো পূর্ণ এবং একটা অর্ধ বর্ণ নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি শব্দ—প্রেম। আপনি যদি শুধু এই শব্দটাই বুঝতে এবং চর্চা করতে শেখেন, মানবতার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। অতএব, আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতের ‘আপনি’ সেই মানুষ, যে ভালোবাসতে জানে।
আপনার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আপনি দেয়াল তুলে দিতে পারেন, যেন বাইরের কেউ প্রবেশ করতে না পারে। আবার এই ক্ষমতায় আপনি দেয়াল ভাঙতেও পারেন, বাইরের মানুষকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেন। আপনার বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে আপনি অন্যকে ভয় দেখাতে পারেন, নতিস্বীকার করতে বাধ্য করতে পারেন। আবার এই বিশ্বাসের শক্তি ছড়িয়ে দিয়েই মানুষকে আলোকিত করতে পারেন। আপনার শক্তি দিয়ে আপনি পারমাণবিক বোমা বানাতে পারেন, ছড়িয়ে দিতে পারেন বিধ্বংসী অন্ধকার। আবার এই শক্তি দিয়েই লাখো মানুষের জীবনে দিতে পারেন আনন্দের ছোঁয়া। অঢেল টাকা দিয়ে আপনি যুদ্ধের আগুন উসকে দিতে পারেন, অস্ত্র কিনতে পারেন, সেই অস্ত্র তুলে দিতে পারেন শিশুদের হাতে। আবার এই টাকা দিয়ে অভুক্ত শিশুর অন্নসংস্থানও হতে পারে।
আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যৎ আপনার মাঝে আছে অসীম সম্ভাবনা। ভারতে একে বলে চক্র। চক্রটা পূর্ণ করতে হলে যেখানে শুরু, সেখানেই এসে মিলতে হয়। আপনি স্থান ও সময়ের গুরুত্ব আলাদাভাবে উপলব্ধি করবেন, বুঝবেন। আপনি আবার মানবিকতার সত্যিকার সরলতায় ফিরবেন। হৃদয় থেকে ভালোবাসবেন, সত্যের চোখে দেখবেন আর অক্ষত মন নিয়ে স্বপ্ন বুনবেন।
ভবিষ্যৎ ‘আপনার’ হওয়া উচিত একজন প্রৌঢ় চিত্রতারকার মতো। যে বিশ্বাস করে এমন একটা পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব, যে পৃথিবী নিজে নিজেকে ভালোবাসে। আপনিই হতে পারেন সেই ব্যক্তি, যিনি এমন একটা পৃথিবী গড়ে তুলতে পারেন। ভদ্রমহিলা ও মহোদয়, আমি সত্যি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যৎ ‘আপনি’ই হতে পারেন সেই মানুষ।