‘মেসির সত্যিকার জাদু কখনোই ইউটিউবে পাবেন না’
- লিডারশিপ ডেস্ক
স্পেনের ফুটবলার জেরার্ড পিকে। ২০১০ সালে স্পেন যেবার বিশ্বকাপ জিতল, এই জয়ের পেছনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর। মাঠের বাইরে পিকের ভাবনার জগৎটা কেমন? পড়ুন দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে লেখা তাঁর নিবন্ধ
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আমি বালক হয়ে ঢুকেছি, আর যুবক হয়ে বের হয়েছি। একটা খ্যাপাটে সময় ছিল বটে। কারণ, এর আগে আমি কখনোই বাড়ি থেকে এতটা দূরে থাকিনি। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত স্পেনেই ছিলাম। বার্সেলোনার ইয়ুথ একাডেমিতে খেলার সময় মনে হতো, এটা আমার স্কুলের আঙিনা। সবাইকে চিনি, সবাই আমার পরিবারের মতো। অতএব, আমার কাছে ফুটবল স্রেফ মজার একটা খেলা ছিল। খেলার সঙ্গে যে একটা ব্যবসা জড়িয়ে আছে, সেটা তখন বুঝিনি। এরপর যখন যুক্তরাজ্যে পা রাখলাম, সত্যি বলছি, আমি রীতিমতো একটা ধাক্কা খেয়েছি।
ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম দিকের একটা প্রিয় ম্যাচের কথা মনে পড়ে। ড্রেসিংরুমে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ভীষণ নার্ভাস লাগছিল। ভেবে দেখুন, আমার বয়স তখন মাত্র ১৮। ড্রেসিংরুমে রুড ভ্যান নিসটেলরয়, রায়ান গিগস আর রিও ফার্দিনান্দের মোজার পাশে আমার মোজা ঝুলছে! পারলে আমি অদৃশ্য হয়ে যেতাম। মনে মনে বলছিলাম, কারও চোখে না পড়ে নিজের কাজটা করে ফিরতে পারলে বাঁচি!
আমি বসেছিলাম রয় কিনের ঠিক পাশে। ড্রেসিংরুমটা এতই ছোট যে ওর পায়ের সঙ্গে পা লেগে যাচ্ছিল। রুমের ভেতর পিনপতন নীরবতা। এমন সময় কোথা থেকে যেন একটা কম্পনের (ভাইব্রেশন) শব্দ শুনতে পেলাম।
বিজজজজ্…বিজজজজ…
রয় আশপাশে তাকাল। আমিও।
আবার।
বিজজজজ…বিজজজ…
মেরেছে! বুঝতে পারলাম, এটা আমার সেলফোন। রয়ের মাথার কাছে আমার যে ব্যাগটা ঝুলছে, সেটার ভেতরে আমার ফোন বাজছে!
শুরুতে রয় বুঝতে পারেনি শব্দটা কোথা থেকে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পাগলের মতো ঘরের এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। দ্য শাইনিং ছবির একটা বিখ্যাত দৃশ্য আছে, যেখানে জ্যাক নিকলসন একটা দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। রয়কে তখন সেই জ্যাক নিকলসনের মতো উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।
সবার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কার ফোন এটা?’
সব চুপ।
রয় আবার একই প্রশ্ন করল।
এবারও নীরবতা।
তৃতীয়বার সে চিৎকার করে উঠল, ‘কোন গর্দভের ফোন এটা?’
অবশেষে আমি মুখ খুললাম। বাচ্চা ছেলের মতো নিচু গলায় বললাম, ‘আমি দুঃখিত। ফোনটা আমার।’
তো আর কী, রয় আমার কাঁধে হাত রাখল আর বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই খোকা!’
অবশ্যই না! মজা করছিলাম। রয় ভীষণ খেপে গেল! এত চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল যে আরেকটু হলেই আমি প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলতাম! কিন্তু এটা আমার জন্য একটা ভালো শিক্ষা ছিল।
এখন, এই ২০১৮ সালে সবকিছু কত বদলে গেছে। এখনকার ছেলেপুলেরা মাঠে নামার আগে আইফোন হাতে বসে থাকে। ২০০৬ সালে এটা ভাবাই যেত না। যুক্তরাজ্যের দিনগুলোতে আমি যে হাজারো ভুল করেছিলাম, এটা সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটা।
শুধু ফুটবল খেলাটাই কঠিন ছিল না। ভাষা, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি একাকিত্ব—সবই আমাকে ভুগিয়েছে। সবার কাছ থেকে দূরে থাকাটা হলো সবচেয়ে কঠিন। ১৭ বছর বয়সী একটা ছেলের জন্য পরিবার থেকে দূরে, সব বিখ্যাত খেলোয়াড়ের সঙ্গে চলাফেরা করা, স্যার অ্যালেক্সের (অ্যালেক্স ফার্গুসন) মতো একজন ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে থাকা…বড় কঠিন। ইংল্যান্ডে প্রথম দুই বছরে এমন অজস্র দিন গেছে, সারা দিন প্রশিক্ষণ শেষে রাতে ঘরে ফিরেছি। আমার ফ্ল্যাটে আমি একা। তখন মা ফোন করতেন আর আমি অবলীলায় মিথ্যা কথা বলতাম, ‘না মা, কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে।’
সব আসলে ঠিক ছিল না। আমার ইচ্ছা করত সব ছেড়েছুড়ে এক ছুটে স্পেনে চলে যাই।
মনে আছে, বাবা তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিলেন। বাবাকে আমি ফোন করে বলতাম, ‘আমি জানি না, বাবা। ম্যানেজার আমার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এরা অনেক বেশি শক্তিশালী। এদের সঙ্গে আমি পেরে উঠছি না।’
বাবা বলেছিলেন, ‘বেশ। একটা কথা কি জানো, আজকের দিনটা হয়তো খারাপ গেছে। কিন্তু মনে রেখো, কাল আবারও সূর্য উঠবে।’
জানি না কেন, কথাটা শুনে ভালো লাগত। সামনে এগোনোর সাহস পেতাম। আমার খুব সৌভাগ্য। কারণ, আমি যতটা জড়সড় ছিলাম, যতটা অপরিপক্ব ছিলাম, স্যার অ্যালেক্স সেই প্রথম দিন থেকে আমাকে ততটাই আগলে রেখেছেন। ভালো ম্যানেজারের মধ্যে এই গুণটা থাকে। সে যদি আপনাকে না খেলায়, সে যদি আপনাকে বকাঝকাও করে, তবু আপনি অনুভব করবেন, দিন শেষে সে আপনার ভালোই চায়। স্যার অ্যালেক্স আমার কাছে বাবার মতো। আমাকে আমার জায়গাটা অর্জন করে নিতে হয়েছে ঠিক, কিন্তু অর্জনের সুযোগটা তিনিই দিয়েছেন।
ক্যারিয়ারে অসংখ্যবার ভাগ্য, সুযোগ, এ রকম না হলে কী রকম হতে পারত…এসব নিয়ে আমি ভেবেছি। পত্রিকার শিরোনামে কিন্তু এগুলো আসে না। শিরোনাম দেখলে মনে হয়, সবকিছু কত সহজ! কিন্তু বাস্তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো থেকে যায় খবরের পেছনে।
উদাহরণ হিসেবে আমি মেসির কথা বলতে পারি। অনেকে প্রশ্ন করে, এত বছর ধরে তুমি মেসির সঙ্গে খেলছ; কেমন লাগে? আমাকে যদি এক বাক্যে বলতে হয়, বলব, সে একটা এলিয়েন। সে এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয়।
সে-ই একমাত্র খেলোয়াড়, যাকে প্রথম দেখার অনুভূতিটা আমার মনে আছে। তখন আমাদের বয়স সম্ভবত ১৩। মেসিকে দেখে মনে মনে বলছিলাম, ‘এই ছেলেটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো জগৎ থেকে এসেছে, এ মানুষ নয়।’
সে একটা খুনি! আমার চোখে সে-ই সেরা। কিন্তু জানেন, আমি কিন্তু ওর আক্রমণের ভঙ্গি দেখে এ কথা বলছি না। মানুষ প্রশ্ন করে, ‘মাঠে লিওর কোন জিনিসটা তোমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে?’ তাদের প্রত্যাশা থাকে, আমি বলব কীভাবে ও রক্ষণভাগের তিনজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাটাকুটি করে বল নিয়ে গেল…এ রকম একটা কিছু। বিশ্বাস করুন, এমন অসংখ্য গল্প আমার জানা আছে।
কিন্তু এই সব কারণে আমি ওকে এলিয়েন বলছি না। আমাকে মেসি মুগ্ধ করে তখন, যখন তার পায়ে বল থাকে না! টিভিতে আপনি হয়তো দেখতে পান না, আমি দেখতে পাই। রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের কাছ থেকে বলটা ফিরে পেতে সে যখন ছোটে, তখন ওর মুখটা দেখবেন। ওর চোখে আমি এমন একটা দৃষ্টি দেখেছি, যেটা আর কোনো ফুটবলারের মধ্যে পাইনি। এটাই তার বিশেষত্বের কারণ। ওর মধ্যে লোক দেখানো কিছু নেই। এমনকি সে খুব কমই ‘স্টেপ ওভার’ করে। মেসি অন্য ধাতুতে গড়া। বল পাওয়ার প্রতি তার যে আকুতি, এটাই তাঁর জাদু। এটা কখনোই শিরোনামে আসবে না। মেসির সত্যিকার জাদুটা আপনি কখনোই ইউটিউবে পাবেন না। এই জাদু লুকিয়ে থাকে ওর চোখের অভিব্যক্তিতে।
ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপে এসে ভাবছি, বিশ্বে আমার অবস্থানটা কোথায়? ভাবছি কীভাবে এত দূর এলাম, জীবনে আর কী কী অর্জন করার ছিল? আমার মনে হয়, খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের উচিত মানুষকে আমাদের জীবন সম্পর্কে আরও বেশি জানানো। তাঁদের বোঝানো, আমাদের মাথার ভেতর কী চলে। এই মানসিকতা আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দরকার।
আপনি যদি মাদ্রিদে বসে টেলিভিশন দেখেন, মনে হবে বার্সেলোনার সবাই দেশটা ধ্বংস করে ফেলছে। আবার আপনি যদি বার্সেলোনায় বসে টিভি দেখেন, মনে হবে মাদ্রিদের জন্য দেশটা রসাতলে গেল।
সবাই খারাপ। তবে সেটা নির্ভর করছে আপনি কোথায় বসে টিভি দেখছেন, তার ওপর।
জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়েছি ফুটবল খেলে। এখন আমার বয়স ৩১। বলেছিলাম, ৩০ বছর বয়সে অবসর নেব। সত্যি বলতে, কোন জিনিসটা আমাকে ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে আগ্রহী করল, জানেন? মাঠের খেলা নয়; মেসি, পুয়োল, নেইমার, রয় কিনের মতো মানুষের সঙ্গে ড্রেসিংরুমে কাটানো সময়গুলো (যদিও রয় কিন ড্রেসিংরুমে আমাকে প্রায় খুন করে ফেলছিল!)
দিন শেষে ফুটবল এক দীর্ঘ যাত্রা। আপনি জিতবেন, হারবেন, লজ্জিত হবেন, ভুল করবেন, হাসবেন, কাঁদবেন, বোকার মতো একটা কিছু করে বসবেন। দলের সবাই মিলে একদিন হয়তো এক সহকারী কোচের নতুন কেনা বাইকে আগুন ধরিয়ে দেবেন…! সেই গল্প না হয় আরেক দিন বলব। (সংক্ষেপিত)