‘নিজের ঘাটতিগুলো খুঁজে বের করুন’
- লিডারশিপ ডেস্ক
অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা সালমান খান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণ শিক্ষাবিদ তাঁর ওয়েবসাইটের (khanacademy.org) মাধ্যমে বিনা মূল্যে শিক্ষার উপকরণ ও উৎসভিত্তিক সহায়তা দিয়ে আসছেন। টেড টকে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন শিক্ষা নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা।
আমি তখন একেবারেই তরুণ। সে সময় দেখলাম, গণিতের সমস্যাগুলো নিয়ে কাজিনরা বেশ ভুগছে। কারণ, তাদের শেখার মধ্যে কিছু ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। এ কারণে তারা যখন বীজগণিতের ক্লাসে যাওয়া শুরু করল, বুঝল যে বীজগণিত-পূর্ব বিষয়গুলোতে তাঁদের ভিত নড়বড়ে হয়ে আছে। যখন ক্যালকুলাস ক্লাসে যাওয়া শুরু করল, বুঝল তাঁদের বীজগণিতের ভিত নড়বড়ে হয়ে আছে। একসময় বলা শুরু করল, গণিতের ‘জিন’ (মানবদেহের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী ক্রোমোজোমের অংশ) তাঁদের মধ্যে নেই।
আমি সেই দিনগুলোতে তাঁদের জন্য কিছু টিউটোরিয়াল ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে দিলাম এবং লক্ষ করলাম, আমার কাজিনদের বাইরেও অনেকে এই ভিডিও দেখছেন। প্রথম দিকে কিছু মন্তব্যও পেতাম, অতি সাধারণ ‘ধন্যবাদ’। সেই সময় এটা অনেক বড় পাওয়া মনে হতো। কিন্তু দিন যত যেতে লাগল, ধন্যবাদ ছাড়াও বেশ কিছু মন্তব্য আসা শুরু করল। ইউটিউবে মানুষ এত সময় দেয়, এই তথ্য আমাকে অবাক করল।
মন্তব্যগুলো বেশ গভীর ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা গণিতকে ভালো না বেসে বেড়ে ওঠার কথা বলছিল, কেন ভালোবাসতে পারেনি সে কথা বলছিল। গণিতের কোনো এক বিষয় আত্মস্থ হওয়ার আগেই আরও কঠিন গণিতের ক্লাস শুরু হয়ে যায় এবং শেষমেশ ওদেরও একই অনুভূতি পেয়ে বসে—সম্ভবত আমার ভেতরে গণিতের জিন নেই।
একটু বড় হলে যখন সে বুঝতে পারে যে শেখার মধ্যে কিছু ফাঁক থেকে গেছে, তারা এজেন্সির (দ্বিতীয় কোনো মাধ্যম) সহায়তা নেওয়া শুরু করে। অনেকে খান একাডেমিরও আশ্রয় নেয় এবং তাদের ধারণার ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ করে। মানসিকতায় পরিবর্তন আসে যে হ্যাঁ, তাঁদের পক্ষেও গণিতে ভালো করা সম্ভব।
এভাবেই আসলে আপনি জীবনে যেকোনো বিষয়ের ওপর দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। মার্শাল আর্টের কথাই ভাবুন। আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না ‘হোয়াইট বেল্ট’ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো অর্জন করছেন, ততক্ষণ হোয়াইট বেল্ট পাবেন না। ইয়েলো বেল্টের ক্ষেত্রেও তাই। যেকোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আপনাকে প্রথমে মৌলিক সুরগুলো চর্চা করে আয়ত্ত করতে হবে। তারপরেই এগোতে পারবেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ‘মডেল’টা এ রকম নয়। চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত বয়সের ভিত্তিতে আমরা একই শ্রেণিতে পড়াশোনা করি এবং সবাইকে একই ধরনের চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই যেমন ধরুন, সূচক পড়ানো হবে। শিক্ষক সূচকের ওপর লেকচার দেবেন, বাসায় এসে আমরা হোমওয়ার্ক করব। পরদিন সেই হোমওয়ার্কের পর্যালোচনা, নতুন লেকচার, হোমওয়ার্ক। সপ্তাহ কয়েক পর আসে পরীক্ষা। ধরলাম সেই পরীক্ষায় আমি পেলাম ৭৫ শতাংশ নম্বর, আর অন্য কেউ পেল ৯০ শতাংশ কিংবা ৯৫ শতাংশ নম্বর। আমরা সবাই কিন্তু পাস করলাম। যদিও আমার ২৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে গেছে। আর যে ৯৫ শতাংশ পেয়ে ‘এ’ পেয়েছে, তারও ৫ শতাংশের ঘাটতি আছে।
এরপর যদি কোনোভাবে আমরা ঘাটতিটা পূরণ করেও ফেলি, তত দিনে দেখা যাবে ক্লাসে নতুন বিষয় পড়ানো শুরু হয়ে গেছে। ধরুন, ঋণাত্মক সূচক কিংবা লগারিদম। তত দিনে আরও কিছু ঘাটতি যোগ হবে। পদ্ধতিটা এমনই। সুতরাং আমি ২৫ শতাংশ মৌলিক বিষয় না বুঝেই পরের অধিকতর কঠিন বিষয়গুলোতে চলে যাচ্ছি। ভিত দুর্বল থাকার কারণে নতুন বিষয়ের অনেক কিছুই আমি বুঝব না এটা স্বাভাবিক। ফলাফল, আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলব।
বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বোঝা যাবে বাস্তবিক জীবনের কোনো উদাহরণ দিলে। একটি বাড়ি তৈরির পদ্ধতির কথাই ধরুন। আমরা একজন ঠিকাদারকে এনে বললাম, ‘দুই সপ্তাহ সময়, বাসার ফাউন্ডেশন তৈরি করে দিতে হবে। তুমি যেভাবে পারো, করো।’
হয়তোবা সে সময় বৃষ্টি থাকতে পারে, বাড়ি তৈরির উপাদানের অভাব থাকতে পারে। তারপরও সময়ের কারণে, সে কোনো না কোনোভাবে তৈরি করল। দুই সপ্তাহ পরে যখন নিরীক্ষক এসে দেখল এবং বলল, ‘কংক্রিট এখনো ভেজা রয়েছে। যেটা মানসম্পন্ন নয়। তাই আমি ৮০ শতাংশ রেটিং দিলাম।’ এরপর কী বলবেন? ‘অসাধারণ, পাস হয়েছে, “সি” পেয়ে গেছি। এবার মেঝে তৈরির কাজে হাত দেওয়া যাক…!’ এক তলার ছাদ সেই আধাআধি তৈরি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেল, দ্বিতীয় তলাও কোনো রকম হলো, কিন্তু তৃতীয় তলায় এসে দেখা যাবে, ভবনটা ভেঙে পড়েছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক এ রকম। আপনি হয়তো বলতে পারেন, ঠিকাদার খারাপ ছিল কিংবা আরও ভালো নিরীক্ষণের দরকার ছিল। কিন্তু দিন শেষে ইমারতটি ভেঙে গেছে এবং ক্ষতির পরিমাণ আপনারই বেশি। সুতরাং, ঘাটতিগুলো খুঁজে বের করুন। সময় দিয়ে সংশোধন করুন। তার ওপর ইমারত তৈরি করতে থাকুন।
‘আইডিয়া অব মাস্টারি’ বা দক্ষতার ধারণা এটাই। আমরা যেভাবে শিখছি, ঠিক তাঁর বিপরীত হওয়া উচিত। সময়ের মধ্যে শিখলাম, তারপর গ্রেড পেয়ে পরের ধাপে চলে গেলাম—তা না করে ঠিক করতে হবে, আমার আসলে কতটুকু শেখা উচিত। শেখার জন্য প্রয়োজনীয় সময় ও শ্রম দিন। তারপর পরের ধাপে যান। নির্ধারণ করে নিন, কোন বিষয়ে কতটুকু দক্ষতা আপনার প্রয়োজন। একই সঙ্গে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে এই পদ্ধতি আমাকে সূচক সম্বন্ধে ভালোভাবে জানাতেই শুধু সাহায্য করবে না, আমার মানসিকতারও পরিবর্তন আসবে। আমি বুঝতে পারব যে সেই ২০-২৫ শতাংশ আমার ডিএনএতে নেই, এ ধরনের যুক্তি অবাঞ্ছিত। বরং আমাকে আরেকটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে, কারও সহায়তা নিয়ে ঘাটতিটুকু দূর করতে হবে।
এখন আপনি বলতে পারেন, এই পদ্ধতি অবাস্তব। একেকজনের বুঝতে একেক সময় লাগবে এবং প্রত্যেকের জন্য আলাদা প্রশ্নপত্র তৈরি করে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। এক শ বছর আগে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। যেখানে তাঁরা ‘মাস্টারি বেজড লার্নিং’ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। কিন্তু দিন শেষে বলেছিল, এটা প্রয়োগ করার মতো যথেষ্ট রসদ বা জনবল নেই।
কিন্তু এখন আর এটা অসম্ভব নয়। আমাদের হাতে প্রযুক্তি আছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে তাঁদের সময়-সুযোগ অনুযায়ী যেকোনো ভিডিও টিউটরিয়াল দেখে ঘাটতি পূরণ করে নিতে পারে। চর্চা করা দরকার? নিজের দক্ষতা যাচাই করা দরকার? সে অনুযায়ী অনুশীলন করার সুযোগও আছে। যখন এসব সম্ভব হবে, তখনই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত অর্থে শিখতে পারবে। তাদের মধ্যে শেখার সঠিক মানসিকতা তৈরি হবে। (সংক্ষেপিত)