সেশনজটের জটাজালে বেরোবি
সজীব হোসাইন, রংপুর : ক্যাম্পাস জীবন যেন শেষ হচ্ছে না বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক স্বল্পতা, শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার প্রতি অনীহা, নিয়মিত বিভাগীয় প্রধান না থাকা, সাপ্তাহিক দুই দিন ছুটি, শ্রেণি কক্ষ সংকট ও ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতায় লাগাম ছাড়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির সেশনজট।
অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ৪ বছরের স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স ৭-৮ বছরেও শেষ হচ্ছে না। হতাশায় নিমজ্জিত এসব শিক্ষার্থীরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি চাকরির প্রতিযোগিতায়ও দিন দিন পিছিয়ে পড়ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেশনজটের কারণে ২০০৮-৯ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের এখনো স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ বিভাগে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে ২ বছরের সেশনজট রয়েছে। বিভাগভেদে এর তারতম্য থাকলেও বেশির ভাগ বিভাগেই ভয়াবহ সেশনজট দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ২১টি বিভাগের মধ্যে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্থনীতি, গণিত, বাংলা ও ইংরেজি বিভাগে সেশনজট দুই বছর ছাড়িয়ে গেছে।
এছাড়া পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, দুর্যোগ ব্যস্থাপনা, পরিসংখ্যান, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, সমাজবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন বিভাগে সেশনজট এক থেকে দেড় বছর। তবে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে তুলনামুলক সেশনজট কম থাকলেও অন্যান্য বিভাগগুলোতে সেশনজট ছয় মাস থেকে প্রায় এক বছর।
কথা বললে বাংলা বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী দি প্রমিনেন্টকে জানান, ২০০৮-৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েও এখনো স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারিনি। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে মনে হয় আরও ছয় মাস লাগবে।
এদিকে প্রায় দুই বছরের সেশনজটে রয়েছে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। যোগাযোগ করলে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন ও গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. মো. তাজুল ইসলাম সেশনজটের ব্যাপারে মুঠোফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে অনুষদের একাধিক শিক্ষার্থীর অভিযোগ সেশনজট নিরসনে ডিন ও বিভাগ দুটির শিক্ষকদের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না নেওয়ার কারনেই অনুষদটির এই বেহাল দশা। বিষয়টি নিয়ে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মো. ফেরদৌস রহমান জানান, সেশনজট ছিল, তবে তা ক্রমান্বয়ে শিক্ষকদের আন্তরিকতায় নিরসনের চেষ্টা চলছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ সেমিস্টার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তৃতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা এক মাস আগে শেষ হলেও চতুর্থ সেমিস্টারের ক্লাস শুরু এখনো অনিশ্চয়তায়। কথা বললে বিভাগটির শিক্ষার্থী হেলাল উদ্দিন দি প্রমিনেন্টকে জানান, আমাদের প্রতিটি সেমিস্টার শেষ হওয়ার পর নতুন সেমিস্টার শুরু হয় এক থেকে দেড় মাসের সেশনজট মাথায় নিয়ে।
যোগাযোগ করলে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন ও গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. মো. তাজুল ইসলাম সেশনজটের ব্যাপারে মুঠোফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে অনুষদের একাধিক শিক্ষার্থীর অভিযোগ সেশনজট নিরসনে ডিন ও বিভাগ দুটির শিক্ষকদের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না নেওয়ার কারনেই অনুষদটির এই বেহাল দশা।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সেশনজটের কারণ হিসেবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. আব্দুল জলিল মিয়ার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবীর বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতির আন্দোলন, শিক্ষক স্বল্পতা, শ্রেণি কক্ষ সংকট, গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তীব্র সেশনজটে পড়েছে।
এদিকে সেশনজট নিরসনে কোনো উদ্যোগ না নিয়েই বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬তম সিন্ডিকেট সভায় ১ নভেম্বর থেকে প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক ছুটি দাঁড়ায় বছরে ১০৪ দিন। এছাড়া শীতকালীন, গ্রীষ্মকালীন, বিভিন্ন দিবস এবং অন্যান্য সরকারি ছুটি মিলিয়ে ছুটির সংখ্যা দাঁড়ায় আরও ৪২ দিন। এতে বছরের ছুটির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫ মাস। বাকি সাত মাসের মধ্যে রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানামুখী আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। যেখানে এক সেমিস্টারের সময়কাল ধরা হচ্ছে ছয় মাস।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে শিক্ষক এবং শ্রেণি কক্ষ সংকট। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর বিভাগসহ মোট সাতটি ব্যাচ রয়েছে। বিভাগটিতে মোট সাত জন শিক্ষক নিয়োগ হলেও শিক্ষা ছুটিতে তিন জন শিক্ষক দেশের বাইরে। বর্তমানে বিভাগটিতে শিক্ষক সংখ্যা মাত্র চার জন। প্রায় একই চিত্র একাধিক বিভাগে। কথা বললে বিভাগটির একাধিক শিক্ষার্থী দি প্রমিনেন্টকে অভিযোগ করে জানান, শিক্ষক স্বল্পতা এবং শ্রেণি কক্ষ সংকটের কারণে বিভাগটি আরও ভয়াবহ সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে কথা বললে একাধিক বিভাগের শিক্ষক দি প্রমিনেন্টকে জানান, উপাচার্য চাইলেই পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এবং সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন করার মাধ্যমে সেশনজট নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন। সাপ্তাহিক দুইদিন বন্ধ থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রমেও জটিলতাসহ ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানান তাঁরা।
কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা দি প্রমিনেন্টকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন ‘আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষকদের স্বার্থে নানামুখী আন্দোলন সংগঠিত হলেও শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি কেবল দীর্ঘ সেশনজট।
অপরদিকে বেতন কাঠামোর বৈষ্যমতা দূর করতে শিক্ষকরা লাগাতার কর্মবিরতি পালন করলেও পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে নেই শিক্ষক সমিতির কোনো পদক্ষেপ। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেশনজট নিরসনে শুক্রবার ও শনিবার ক্লাস-পরীক্ষা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সেশনজট নিরসনে উদ্যোগ না নিয়ে রশি টানাটানি অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবীর। উপাচার্যের দাবি শিক্ষকদের নানামুখী আন্দোলন এবং ক্লাস পরীক্ষা নেওয়ায় অনাগ্রহের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট দেখা দিয়েছে। তবে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, উপাচার্য বেশ কয়েকটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং তিনটি অনুষদের ডিন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার ফলেই অনুষদ এবং বিভাগ গুলোতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।