ইতিহাস-ঐতিহ্যের কাছে বেরোবির লোকপ্রশাসন বিভাগ

ইতিহাস-ঐতিহ্যের কাছে বেরোবির লোকপ্রশাসন বিভাগ

সজীব হোসাইন, রংপুর: ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ পাওয়া খুব কষ্টের। আনন্দ আর শিক্ষা সফর দুটো যেন এক সুতোয় গাঁথা। আর যদি তার আয়োজক হয় বিভাগ, তাহলে তো কথাই নেই। বন্ধু, বড় ভাই ও শিক্ষকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সত্যিই মজার।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে দিনটা ছিল স্বপ্নের মতোই। শীতের সকালে লেপের প্রেম ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া আনন্দের খোঁজে। দিনটিতে বিভাগের ছোট-বড় সবাই যেন এক হয়েছিল। সবার মাঝেই ছিল শুধুই আনন্দ খোঁজা। তবে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষনীয় বিষয়গুলো বাদ যায়নি। ঘুরতে গিয়েও অনেক কিছু শেখা হয়েছে।

গত ৮ জানুয়ারি সকাল ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস যাত্রা করে বগুড়ার উদ্দেশ্যে। প্রধান গন্তব্য মহাস্থানগড়। এক সময়ের বাংলার রাজধানী ছিল যার পূর্বের নাম পুন্ড্রনগর, যেখানে মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন সাম্রাজ্যের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায়।

রংপুর শহর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে শীতল বাতাস সবাইকে কাঁপিয়ে দিল। কিন্তু সেই কাপুনি বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকতে পারেনি শিক্ষার্থীদের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে। তাদের বেসুরো গানও যেন সেদিন সবার মনে আনন্দ জাগিয়ে দিচ্ছিল। সাথে অনেকের নাচ শরীরে উষ্ণতা ছড়াচ্ছিল। কিন্তু সেই উষ্ণতা থামিয়ে দিল করতোয়ার নদীর উচ্ছলতা।

বাহিরের হালকা কুয়াশার চাদড় ছিঁড়ে মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যেই বাস গিয়ে পৌছল মহাস্থানগড়ে। দুটি বাস থেকে একে একে সবাই নেমে পড়লেন। অনেক আগে থেকেই সবার পেট খিদায় চিন চিন করছিল। কিন্তু নাচ-গানের তালে কেউ তা বুঝতেই পারেনি। এমন সময় দেওয়া হলো সকালের নাস্তা। একটু শক্তি বাড়িয়েই সবাই দৌড় দিল গোবিন্দ ভিটায়। যেখানে রয়েছে মহাস্থানগড় জাদুঘর।

মহাস্থানগড় খনন করে গুপ্ত, মৌর্য, সেন ও পাল বংশীয় যুগের যেসব প্রস্তর খণ্ড ও দেবদেবীর মূর্তি, নকশা করা ইট-পাথরের টুকরো ও মূল্যবান পাথরের অলংকার পাওয়া গেছে তার সবই এই জাদুঘরে রক্ষিত রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধাতুর তৈরি অস্ত্র, পাত্র, মুদ্রা, স্মারক। চোখ জুড়ানো মহাস্থানগড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য প্রাচীন কীর্তি দেখতে বিভাগের শিক্ষার্থীরা যেন বাঁধন-ছেঁড়া। কেউ হজরত শাহ সুলতান (রহ.)-এর মাজারে শরীফে কেউ বা আবার নানি, দাদি অথবা মা-বাবার কাছে শোনা বেহুলার বাসরঘরটাও দেখে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করছে না। চোখ এড়াচ্ছে না বিভিন্ন স্থানে লেখা সাইনবোর্ডের নানা অজানা তথ্য। পড়তে পড়তেই নিজেকে কেউ খুঁজছেন সেন, মৌর্য, গুপ্ত বা পাল রাজবংশে। কেউবা মিলিয়ে নিচ্ছেন বর্তমানের সাথে সেই পুন্ড্রনগরকে। বৃহত্তর বরেন্দ্রভূমির অংশ যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ ও গৌরবময় একটি সভ্যতা।

মনে কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই আবার যাত্রা শুরু প্রাচীন বৌদ্ধবিহার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের উদেশ্যে। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা। আবার শুরু তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। গাড়ি ছুটে চলছে তার আপন গতিতে বরেন্দ্রভূমির কোল ঘেঁষে। বিভাগের তিনটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মাঝে যেন আর বড় ভাই-ছোট ভাই বিভেদ নেই। আনন্দ নেওয়াটাই বড় কথা। ছোট-খাট ভুল ত্রুটি যেন গৌণ্য বিষয়। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর দুইটা। বাস গিয়ে থামল পালবংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপালের বিহারে। এটি সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার নামেও পরিচিত। যেটা অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে নির্মিত হয়েছিল। এবার ঘুরে দেখার পালা ১৮৭৯ সালে আবিষ্কার করা স্যার কানিংহামের এই বিশাল কীর্তি। এটিকে ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়।

অপরদিকে চলছে রান্নার কাজ। ততোক্ষণে বিহারজুড়ে কালো ট্রি-শার্ট পড়া শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে পড়েছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়েই চষে বেড়াচ্ছে বিহার। স্মৃতি স্থায়ী করে রাখতে থেমে নেই স্মৃতি ধারণ করার যন্ত্র। কেউ তুলছে সেলফি কেউবা গ্রæফফি। ব্যস্ত সবাই নিজের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রাচীন এই বৌদ্ধবিহারে নিজের পদ চিহ্ন এঁকে দিতে। ছবি তুলতে তুলতেই জমে উঠছে আড্ডা। ‘কোঁথাও আমার হারিয়ে যেতে আজ নেই মানা’ গান আর সাথে গিটারের টুং ট্যাং আওয়াজ।

রান্না শেষ, খবর আসাতেই ব্যস্ততা এবার খাওয়ার পালায়। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। খাবার আয়োজনের তত্বাবধানে বিভাগটির শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান মণ্ডল, সাব্বির আহমেদ চৌধুরী এবং উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক মীর তামান্না ছিদ্দিকা। খাওয়ার পর্ব যখন শেষ ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা।

গাড়িতে উঠেই আবার শুরু তারুণ্যের উন্মাদনা। ক্লান্তিহীনভাবে যখন প্রিয় ক্যাম্পাসে বাস পৌছাল, তখন ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে ১০টা। কিছু দিন পরেই হয়তো ক্লাস আর পরীক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ব কিন্তু পুন্ড্রনগরকে ঘিরে সেই আনন্দ মুখর সময়টুকু স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকবে, দিয়ে যাবে সেই সময়ের জানান।

২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে লোকপ্রশাসন বিভাগ। শুরুটা যেমনই হোক বিভাগটি ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের স্থান করে নিয়েছে গৌরবের সাথেই। সহশিক্ষামূলক সংগঠনের মাধ্যমে নিয়মিত চর্চায় থাকছে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক পর্ব, বিতর্ক, রিডারস্ ক্লাব। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসসহ অন্যান্য বিশেষ দিবসগুলো পালনে ভিন্ন আঙ্গিকে সাঁজে লোকপ্রশাসন বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয় শিক্ষা সফর।favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment