চলে গেলেন ললিত রেখে গেলেন প্রশ্ন
সজীব হোসাইন, রংপুর : নিজেকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলা আর পরিবারের আর্থিক দৈন্য ঘোচানোর আশায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন মেধাবী তরুণ ললিত রায়। ভর্তির শুরু থেকেই তার শিক্ষা জীবন ছিল অনিশ্চয়তার ভরা। দিনমজুর বাবার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল তার পড়াশোনার ব্যয় বহন করা। তবু ললিত স্বপ্ন দেখতেন, পড়ালেখা শেষ করে বাবার দুঃখ দূর করবেন। কিন্তু অর্থাভাব আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ সেশনজট হয়ে দাঁড়াল ললিতের স্বপ্নপূরণের পথে প্রধান বাধা। না বলা অনেক কথা বুকে চেপে রেখেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে চলে গেছেন ললিত রায়।
দরিদ্র পরিবারে তিন ভাইয়ের মধ্যে ললিত ছিলেন মেজো। বড় ভাই নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকত্তোর সম্পন্ন করলেও চাকরি মেলেনি আজও। তাই তিনি খুব একটা সাহায্য করতে পারতেন না ললিতকে। ললিতের পড়াশেনার খরচের অনেকটা মেটাত তার ছোট ভাই। অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা কিছু উপার্যন করত তার সবটাই তুলে দিত ললিতের হাতে। এ নিয়ে অনুশোচনার অন্ত ছিল না ললিত রায়ের। দুঃখ করে বলতেন- ‘আমি কেমন বড় ভাই, যে কিনা ছোট ভাইকে না পড়িয়ে তার টাকাতেই পড়ছি?’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের সহযোগিতায় একটা টিউশনির সন্ধান মিললেও বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে টিউশনিটি হাতছাড়া হয়ে যায়! কারণ তার ছাত্র ছিল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র। বড় ভাইয়েরা ললিতকে বলে দিয়েছিলেন জিজ্ঞাসা করলে বলবে- ‘তুমি ইংরেজি বিভাগে পড়।’ ললিত বলতে পারেননি। মিথ্যা কথা একদমই মুখে আসে না তার।
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ সেশনজট তার এই অবসাদগ্রন্ত জীবনকে করেছিল আরও যন্ত্রণাময়। আর্থিক সংকটে থাকতে থাকতে ভীষণ হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন। একসময় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। অবশেষে ক্যাম্পাস ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান একদিন। বন্ধুরা আশা করেছিল ললিত সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসবে তাদের মাঝে। কিন্তু অভিমানী ললিত আর ফিরে আসেননি। জীবনযুদ্ধে পরাজিত ললিত গ্যাস ট্যাবলেট খেয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়দুদ বলেন, ‘ক্লাসে ললিত প্রায়ই চুপচাপ থাকত। তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে বিভাগে কিছুই জানায়নি কখনো।’
ললিত রায়ের বন্ধুরা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি এবং নানামুখী সমস্যার বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার ছিলেন ললিত। তিনি চাইতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ হোক, সেশনজট দূর হোক, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ হোক।’
ললিত রায়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলে লতিতের বড় ভাই তুষার চন্দ্র রায় দি প্রমিনেন্ট বলেন, ‘আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে হীনমন্যতায় ভুগত ললিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিয়েও তাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখা যেত। ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে হয়ত সুস্থ হয়ে যেত।’
এদিকে মেধাবী সহপাঠীকে হারিয়ে বন্ধুদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। ‘কেন সময়মতো ললিতের পাশে দাঁড়াতে পারিনি? আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারছি না বলেই ললিতদের আত্মহত্যা করতে হচ্ছে’-বলছিলেন এক বন্ধু। আরেক বন্ধু বলছিলেন, ‘ললিতের আত্মহত্যার জন্য আমাদের যেমন দায় রয়েছে তেমনি দায় রয়েছে সমাজেরও। আমরা আমাদের সমাজকে কী সবার জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে পেরেছি?’