মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির স্বর্ণযুগ কি ধূসর হতে চলল?

মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির স্বর্ণযুগ কি ধূসর হতে চলল?

  • আব্দুল্লাহ আল মামুন

আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে কাজ করছেন লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি প্রবাসী। কিছুদিন ধরে পুরো অঞ্চলে কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তার কালো ছায়া যেভাবে বিস্তার করে চলেছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। তার অন্যতম কারই হলো জ্বালানি তেলের দরপতন। বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য পরিবর্তনের সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতি, ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে এক অজানা শঙ্কায়।

২০০৮ সালে জুলাইতে তেলের মূল্য অবিশ্বাস্য রকমের বেড়ে ব্যারেল প্রতি সর্বোচ্চ ১৪৫ ডলারে উঠলেও তা ২০১৪ সালের মাঝামাঝি আশঙ্কাজনক হারে পড়তে শুরু করে। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে ছুটে চলা দ্রুত রোলার কোস্টারের মতো তা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি নেমে গিয়ে ত্রিশ ডলারের নীচে এসে ঠেকে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশেগুলোর বাজেট তেলের মূল্যের উপর ভিত্তি করেই করা হয়। তাই তেলের আকস্মিক দরপতনে তাদের বাজেটে বিশাল ঘাটতি দেখা দেয়। তেলের মূল্য এখন কিছুটা বেড়ে গিয়ে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করলেও, মধ্যপ্রাচ্যের তেল নির্ভর দেশগুলো সেই ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শুধু কি তাই? বাংলাদেশসহ তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানিকারক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ হচ্ছে সৌদি আরব। তেলের মূল্য নাটকীয়ভাবে কমে যাবার ফলে সৌদি আরব বিশাল বাজেট ঘাটতির মুখে পড়েছে। সরকারের কোষাগারে আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজছে। বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য বেসরকারি খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সৌদি সরকার। তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য ও বিকল্প জ্বালানির প্রসার করা হচ্ছে। সম্প্রতি সৌদি আরব পর্যটন থেকে আয় বাড়ানোর জন্য ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্থানগুলো সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। ওমরার জন্য সৌদি আরবে অভ্যাগত অতিথিদের সংখ্যাও প্রায় চারগুণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া সরকারি, বেসরকারি খাতে স্থানীয় নাগিরকদের কর্মসংস্থানের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। যেমন সৌদি আরবে এখন টেলিকম সেক্টরে শতভাগ সৌদিকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সৌদি নাগরিক ছাড়া কেউ এখন দোকানে মোবাইল ফোন বিক্রি করতে পারবে না। স্বাস্থ্য খাতেও একই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ফলে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরছেন লক্ষ লক্ষ প্রবাসী কর্মচারী। বিদ্যুত্ এবং পানির মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনি সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের বেতন এবং কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তেল সমৃদ্ধ দেশ কাতারের পরিস্থিতিও একই। তেলের মূল্যহ্রাসের ফলে ১৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছে কাতার।  ২০২২ সালের বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে সে জন্য  বিশ্বকাপের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয় এমন ধরনের বড় বড় অবকাঠামো প্রজেক্ট সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে, ধীরগতিতে এগুনোর পরিকল্পনা করেছে কাতার সরকার। কাতারের তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো পুনর্বিন্যাস করে আগামী দু’বছরের মধ্যে ২০ শতাংশ প্রবাসী কর্মচারী ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করেছে। কাতারের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি কাতার পেট্রোলিয়াম থেকে সম্প্রতি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়েছে। কাতারের সরকারি মন্ত্রণালয়গুলোতেও কর্মীসংখ্যা কমানোর নির্দেশনা এসেছে। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রবাসী কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। সম্প্রতি কাতারের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দেহের মাত্রাধিক ওজনের অজুহাতে চাকরিচ্যুত হয়েছেন কয়েকজন প্রবাসী কর্মচারী। সব মিলিয়ে গত কয়েক মাসে প্রায় দেড় লক্ষ প্রবাসীকে কাতার ছাড়তে হয়েছে।

এই অঞ্চলে কর্মরত প্রবাসীদের জন্য চরম দুঃসংবাদ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সহসা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বা মূসক আরোপ করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো এই ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছে। ২০১৮ সাল থেকে ৫ শতাংশ হারে মূসক আদায় করা হবে। তেলের দরপতনের কারণে যে বাজেট ঘাটতি হচ্ছে তা মোকাবিলা করতে সরকারের আয় বাড়ানোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট ভোগ্যপণ্যসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ খাতে অর্থব্যয় মূসকের আওতামুক্ত থাকবে। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লাভের সীমা সঙ্কুচিত হবে এবং কর্মসংস্থানের উপর নেতিবাচক ফলবে।

কুয়েতে সরকারি অফিসে পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রবাসী কর্মচারীদের চাকরিতে আর রাখা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কুয়েত সরকার। এদিকে বাহরাইনে সরকারি চাকরি থেকে বিদেশি কর্মীদের বাদ দিতে আইন সভার সদস্যরা একটি প্রস্তাব করেছেন। বাহরাইনের বেকার নাগরিকদের চাকরিতে সুযোগদানের জন্যই এই প্রস্তাব আনা হয়েছে। এটি অনুমোদিত হলে বিদেশি কর্মীদের চুক্তি আর নবায়ন করা হবে না। ফলে চাকরি হারাতে পারেন বহু প্রবাসী। এছাড়া বাহরাইন থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের উপরও করারোপের কথা ভাবা হচ্ছে।

আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের সাতটি দেশ আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত এং ইয়ামেন নিয়ে গঠিত হয়েছে উপসাগরীয় আঞ্চলিক জোট  গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)। এই জোটের একটি দেশ কোনো সিদ্ধান্ত নিলে অন্য দেশগুলো সাধারণত তা অনুসরণ করে। তাই তেলের মূল্য প্রত্যাশিত পর্যায়ে না আসলে ভ্যাটের পর পরই, ব্যক্তিগত আয়ের উপরও করারোপ করা হলে অবাক হব না। করবিহীন আয়ের জন্যই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাকরি নিয়ে ছুটে আসছে মানুষ এই অঞ্চলে। তেল সমৃদ্ধ দেশে এসেও যদি কর দিতে হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি মানুষের সেই রঙিন আকর্ষণ আর থাকবে না।

তেলের বাজারে যে মন্দাভাব চলছে যদিও খুব শিগগির তার অবসান হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবুও চাকরি নিয়ে সহসা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেবার আগে সবার এখন ভেবে দেখা উচিত।

লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রকৌশলী

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment