উন্নয়নে নারীদের গৌরবময় অগ্রযাত্রা
- এসএম মুকুল
বাঙালি নারীদের জাগরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের জাতীয় সত্তার এ দুই মুক্তির সংগ্রামে নারীদের অসীম ত্যাগ, সাহস এমনকি পুরুষদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। তারপর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে পুরুষতান্ত্রিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে মোকাবেলা করে নারীরা স্বগর্বে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির সোপানে। যার সুফল আসছে ঘরে-বাইরে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে। কাজেই বাঙালি নারীরা ঘর-সংসার, রান্না-বান্না আর স্বামী-সন্তান, শ্বশুরালয়ের সেবাযত্নে জীবন পার করার সেই দিন এখন আর নেই। বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে না নিলেই ভালো। কেননা, দিন অনেক বদলে গেছে। বাংলার নারীরা এখন পুরুষদের সমানতালে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সামলিয়েও আগের মতোই ঘর-সংসার আর সেবা-যত্নের সব তাল ঠিক রাখছে।
এই ধরুন প্রায় শতবর্ষ আগে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন উন্নয়নে নারীদের অংশীদারিত্বের যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথ ধরেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অধিষ্ঠিত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়েছে। তাই পুরুষদের সহযোগিতা নিয়ে আজ সবখানে নারীর ভূমিকা প্রায় সমানে সমান। কোথায় নেই নারীর স্বগর্ব অবস্থান- শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতি, বাণিজ্য থেকে শিল্পকর্ম, সাংবাদিকতা থেকে বৈমানিক, ঝুঁকিপূর্ণ মিশন থেকে সেবা ধর্মে সবখানেতে আছে নারীর সমুজ্জ্বল ভূমিকা। আমাদের জানা আছে বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্প শ্রমে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। এখন আর গৃহকর্মে বাঙালি নারীর সুনিপুণতা কিংবা সাহিত্যে সৃজনী পদচারণায় সীমাবদ্ধ নয়_ একথা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে নারীর শ্রমই অন্যতম নিয়ামক শক্তি। আধুনিক সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গিও। তারই প্রতিফলন সাধারণ পেশার বাইরে চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হয়ে নারীরা বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছে। অর্থ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান মাস্টার কার্ডের ‘মাস্টার কার্ড ইনডেক্স অব উইমেনস অ্যাডভান্সমেন্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের নারীরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। ২০১৪ সালে ইনসিডিন বাংলাদেশ নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক জরিপে উল্লেখ করা হয়- বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোয় নারীর অবদান কেবলই বাড়ছে। সেখানে আরো বলা হয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান বিশেষত কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে ৫৩ শতাংশ আর পুরুষের অবদান ৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে-বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। ষোল কোটি মানুষের দেশে নারীদের এই বিশাল অংশের কর্মক্ষম ভূমিকা জাতীয় অর্থনীতির চাকাতে গতিময় রাখছে-এটাই বাস্তবতা।
একথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, নারীদের শিক্ষা ও দক্ষতা যত বাড়বে পেশাদারিত্বে দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ এবং দেশের উন্নয়নে নিজেদের মেধাকে ততই কাজে লাগাতে পারবে। তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালের পর থেকেই দেশের নারী শিক্ষায় ইতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েদের শিক্ষার চাহিদা, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ এবং কলেজপর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৭ শতাংশ ছাত্রী। বর্তমানে সরকারি চাকুরের মধ্যে নারী মাত্র ২৪ শতাংশ। তবে প্রাইমারি স্কুলের চাকরিতে এ হার ৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৩ শতাংশ।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের এই অংশগ্রহণের সুফল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অচিরেই আরো প্রভাব বিস্তার করবে।
নারীদের কোনো অজুহাতেই দমিয়ে না রেখে বরং তাদের সহযোগিতা করলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তনের ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটবে। চারপাশে বিদ্যমান নানামাত্রিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশের নারীরা। সার্ক অঞ্চলে বিভিন্ন দেশে নারী নিগ্রহের তুলনায় অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাবিস্নউএইচও) মতে, নারীদের উন্নয়নে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া এবং নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশের বেসরকারি সেক্টরে মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন নারী উদ্যোক্তারা। নারীরা তাদের শিক্ষা, মেধা আর সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্প গড়ে তুলছেন। পোল্ট্রি, দুগ্ধ খামার, ফিশারি, পাট পণ্য উৎপাদন, বুটিক, হ্যান্ডিক্র্যাফটস, আইসিটি ফার্ম, অনলাইন বিপণন থেকে শুরু করে নতুন নতুন সৃজনী এমনকি উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে সফলতার অনন্য স্বাক্ষর রাখছেন। তাদের এসব উদ্যোগের ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং নতুন নতুন পণ্য বাজারও সৃষ্টি হয়েছে। এসব কিছুই আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পেছন থেকে শক্তি জোগাচ্ছে। নারী বিপ্লবের বড় ক্ষেত্র পোশাকশিল্প। এই শিল্পে ৩০ লাখ নারীশ্রমিক কাজ করছেন। বিবিএসের সমীক্ষা বলছে- বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ নারী-পুরুষ কোনো না কোনোভাবে কাজে সম্পৃক্ত। দেশের কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে এক লাখ বেশি নারীশ্রমিক কাজ করেন। বিভিন্ন কারখানায় বর্তমানে ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারীশ্রমিক রয়েছেন। দেশে কলকারখানার সংখ্যা অন্তত ৪২ হাজার, এরমধ্যে ২ হাজার ১৭৭টি ক্ষুদ্র মাঝারি ও বড় কারখানার মালিক নারী। এই সাফল্যও কম নয়। বাংলাদেশে ১ কোটি ৬ লাখ লোক গৃহস্থালির কাজ করেন। তাদের সিংহভাগই নারী, যাদের শ্রমের মূল্য হিসেবের খাতায় আসে না। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে- পরিবার পরিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যাসহ সংসার ও আবাসকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে নারীর নীরব অবদানের অর্থমূল্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। সুতরাং দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা বহুমাত্রিক এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে গৌরবময় ও সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলার মেধাবি নারীরা। বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন- বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ড. এন নীনা আহমাদ। ব্যারিস্টার স্বপ্নারা খাতুন প্রথম বাংলাদেশি যাকে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ জজ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এমপি নির্বাচিত হয়েছেন রুশনারা আলী, রেজওয়ানা সিদ্দিক টিউলিপ, রূপা হক। ‘বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো’ আসনের এমপি রুশনারা আলীকে ট্রেড এনভয় নেটওয়ার্কের বাংলাদেশবিষয়ক বাণিজ্যদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। সংশ্লিষ্ট দেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা রয়েছে এবং এ বিষয়ে অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সরাসরি এই পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘নিউ হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্গ’ আসন থেকে লেবার পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছেন টিউলিপ সিদ্দিক। পার্টির রাজনীতিতে সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়াবিষয়ক শ্যাডো মন্ত্রী মাইকেল ডাগারের ব্যক্তিগত সচিবের (পিপিএস) স্থায়ী দায়িত্ব পান। অটিজম বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তিনি গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসনও বটে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ পুরস্কার অর্জন করে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর কর্মকাণ্ডেও বাংলাদেশের নারীরা দক্ষতার সঙ্গে প্রশংসনীয় দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন আইভরি কোস্টে ৫৬ সদস্যের একটি মেডিকেল কন্টিনজেন্টে কর্নেল ডা. নাজমা বেগম নারী কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নারী সাফল্যের আরেকটি অর্জন নাজনীন সুলতানার বাংলাদেশের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর নিযুক্তি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান এশিয়ার নোবেলখ্যাত র্যামন ম্যাগসাসে পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশের নারীর কৃতিত্বকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করিয়েছেন। কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে এসটি জোনস শহরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের ৫০তম বার্ষিক সম্মেলনে ‘আইএডাবিস্নউপি-২০১২’ পুরস্কারে ভূষিত হন বাংলাদেশি কৃতী নারী আবিদা সুলতানা। বাংলাদেশের নারী আলোকচিত্রীদের মধ্যে তাসলিমা আখতার আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী ৫০ উদ্যোক্তার তালিকায় বিশ্বখ্যাত নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সুমাইয়া কাজী। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বর্ষসেরা অভিযাত্রীর খেতাব পেয়েছেন ওয়াসফিয়া। খেলাধুলায় ও কসরতের সাহসী কর্মযজ্ঞে পিছিয়ে নেই নারী। হিমালয় শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করার মতো দুঃসাধ্য কাজ করে দেখিয়েছেন প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদার। টেবিল টেনিস খেলোয়াড় জোবেদা রহমান লিমু কিংবা দাবা সাম্রাজ্ঞী রানী হামিদ, সালমা খাতুন এবং ভারতে আয়োজিত এসএ গেমসে অংশগ্রহণকারী প্রমীলা ভারোত্তলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত দেশের ক্রীড়াঙ্গনের এই মুহূর্তের সেরা তারকা।
বাংলাদেশের নারীরা এখন শুধুই নারী হিসেবে নয়-তাদের মূল্যায়ন নক্ষত্রতুল্য। রাজনীতিতে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের সুযোগ স্রষ্টি করার জন্য ইউনিয়ন কাউন্সিল ও উপজেলা পরিষদে এবং পৌরসভায় সংরক্ষিত নারী আসন এক-তৃতীয়াংশে উন্নীতকরণ এবং সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বের শীর্ষ দশে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাবিস্নউইএফ) রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক সমতা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নারীর উন্নয়নে একটি আদর্শ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডাবিস্নউইএফের গবেষণা মূল্যায়নে কেবলমাত্র নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশকে পেছনে ফেলে এসেছে। রাজনীতিতে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস করে আঞ্চলিক নেতৃত্বে সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ মর্যাদাপূর্ণ ওমেন ইন পার্লামেন্টস (ডাবিস্নউআইপি) গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে। এসব মূল্যায়নের কারণ- প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। নারীশিক্ষা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে জাতিসংঘের অন্যতম বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশেষ স্মারক ‘ট্রি অব পিস’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফরচুন বিশ্বের মহান ৫০ জন নেতার তালিকায় ১০ নাম্বারে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সেনাবাহিনীসহ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন শাখাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে উচ্চপদগুলোতেও নিযুক্ত হচ্ছেন নারীরা। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নারীরা প্রশাসনের সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ববাসীর বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পরিচালনায় নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। আধুনিক বিশ্বের উপযোগী হয়ে নারীরা সাংবাদিকতায় অকুতোভয় ভূমিকা রাখছেন। প্রথমবারের মতো দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। বুয়েটের প্রথম নারী উপাচার্য হয়েছেন খালেদা একরাম। দেশের প্রথম নারী বিচারপতি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন নাজমুন আরা সুলতানা। দেশের প্রথম নারী ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নাজনীন সুলতানা নারীসমাজের কৃতিত্বকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চাঁদপুর জেলার পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পুলিশ সপ্তাহের প্যারোডে নেতৃত্ব দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দেশে প্রথম নারী ছত্রীসেনা হিসেবে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস সফলভাবে ১ হাজার ফুট উঁচু থেকে অবতরণের সম্মান অর্জন করেন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নারীরা বাণিজ্যিক জাহাজে নাবিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বিভিন্ন জাহাজে মেরিন অফিসার পদে যোগ দেন। দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক হিসেবে উম্মে সালমা সিদ্দিকার পথ ধরে বর্তমানে রেল চালনায় যোগ দিয়েছেন ১৫ জন নারী। বন বিভাগের বিশাল সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা, বন্যপ্রাণীসহ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখে প্রথম ‘ওয়াংগারি মাথাই’ পুরস্কার অর্জন করেন খুরশিদা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফা ইসহাক হয়েছেন ‘জাতীয় পরিবেশ অলিম্পিয়াড-২০১২’-এর ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন্স’। নারীদের অগ্রযাত্রায় এমন সফলতার কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না।
বাংলার নারীরা শুধুই এগিয়ে যাচ্ছেন তা নয়, অর্থনীতির চাকাকে গতিময় করছেন এবং বাংলাদেশকে সঙ্গে করে বিশ্বময় সফলতার নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করছেন। এই গৌরবময় অগ্রযাত্রা আর থামার নয়। এই একুশ শতকের বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল ঘোষণার পর মিডিয়ায় প্রচারিত সাফল্যের নজির হিসেবে বাংলা মায়ের মেয়েদের ভি চি?হ্ন প্রদর্শিত উল্লসিত ছবিগুলো দেখে আরো আশাবাদী হই আমরা। কেননা আজকের কিশোরীদের এই প্রাণোচ্ছল সফলতার হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো আগামীর বাংলাদেশে তথা বিশ্বে নারী অগ্রগতিতে নতুন বার্তা দিচ্ছে। জয়তু বাংলার নারী- তোমাদের পাশে আছি আমরাও।