প্রযুক্তির হাত ধরে ব্যবসায় বদল
- শওকত হোসেন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘আবাসন ব্যবস্থা’ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের (এয়ারবিএনবি) অধিকারে কোনো হোটেল, রিসোর্ট বা গেস্ট হাউজ নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবহন ব্যবসায়ী (উবার) হওয়ার জন্য গাড়ি কেনার প্রয়োজন হয়নি (অবশ্য সেরা হওয়ার পর উবার চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে গবেষণা করছে। সেই সুবাদে গাড়ির মালিক হবে)। সর্ববৃহৎ খুচরা ব্যবসায়ী আলিবাবা— ২০১৬ সালে (এপ্রিল-মার্চ) যার আয় ১৫ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার আর মুনাফা ১১ বিলিয়ন ডলার, তার ৬৪ বিলিয়ন ডলার সম্পদ থাকলেও গুদামজাত কোনো পণ্য নেই।
এয়ারবিএনবির প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান চেস্কি (১৯৮১) মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বিলিয়নেয়ার ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন। সম্প্রতি (জুন ২০১৬) বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেটের ‘প্রদানের পণ’ (গিভিং প্লেজ) গোষ্ঠীতেও যোগ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোডে আইল্যান্ড স্কুল অব ডিজাইন থেকে ২০০৪ সালে পাস করে ক্যালিফোর্নিয়ায় এক প্রতিষ্ঠানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার হিসেবে চাকরি নেন। পরে সানফ্রান্সিকোয় নিবাস গড়েন। বন্ধু গেব্বিয়ার সঙ্গে একটা রুম ভাড়া নেন। ২০০৭ সালে আমেরিকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন সোসাইটি একটা কনফারেন্সের আয়োজন করে। শহরের সব হোটেল বুক হয়ে যায়। অনেকে কনফারেন্সে আসতে চাইছেন কিন্তু হোটেলে রুম পাচ্ছেন না বলে আসতে পারছেন না। ব্রায়ান তখন টাকা-পয়সার টানাটানিতে। ঠিক করলেন, তাদের রুমটা সাবলেট দেবেন। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। তিনটা ফোম বা এয়ারবেড কিনে আনলেন। উদ্ভট ধরনের এক অফার তৈরি করলেন— ‘এয়ারবেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’। অর্থাৎ বিছানা আর নাশতা। সেখান থেকে ‘এয়ারবিএনবি’ নামের উৎপত্তি। প্রথম রাতেই মিলে গেল তিনজন অতিথি। ভাবলেন, ভালোই তো, ব্যবসাটা মন্দ না! কোমর বেঁধে নামলেন। যেখানে কোনো জমজমাট অনুষ্ঠান হতো, সেখানে আবাসিক (হোটেল) ব্যবস্থার ঘাটতি থাকলে এয়ারবিএনবি ঝাঁপিয়ে পড়ত।
আমেরিকার নির্বাচনের বছর। ওবামা আর ম্যাক কেইনের নামে প্রাতরাশের নতুন এক আইটেম তৈরি করলেন। হটকেকের মতো চলল। নাশতার এই অভিনবত্ব দেখে ২০০৮ সালে ওয়াই কম্বিনেটর এক্সেলেটর প্রোগ্রামে তাদের গ্রহণ করল ও সিড ফান্ড প্রদান করল। সিড ফান্ড হলো, কোনো একটা ব্যবসায়িক ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রদত্ত অর্থ। প্রথম বছরেই তিনি তার ব্যবসার বিশ্বায়নে নজর দেন। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার লোক এয়ারবিএনবির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালের ব্রাজিল অলিম্পিকের অন্যতম স্পন্সর ছিল তারা। ২০১৫ সালের মার্চে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন করা হয় ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার, টাকার অংকে যা ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ২০১৬-১৭ বাজেটের প্রায় অর্ধেক (৪৭%)। এয়ারবিএনবি গত বছর ১ বিলিয়ন ডলার তহবিল উত্তোলন করে। কোম্পানির মূল্য ধরা হয় ২৪ বিলিয়ন ডলার। চার হাজার হোটেলের মালিক ম্যারিওট গ্রুপ, যাদের গত বছর আয় ছিল ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, তাদের মূল্য ধরা হয়েছে ২১ বিলিয়ন ডলার (ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল)। বায়বীয় সম্পদের ওপর গড়ে ওঠা কোম্পানি ‘কঠিন সম্পদের’ কোম্পানিকে কীভাবে টেক্কা দিচ্ছে!
প্যারিসের এক বরফ পড়া সন্ধ্যায় ট্রাভিস কালানিক ও গেরেট ক্যাম্পের ট্যাক্সি পেতে দারুণ বেগ পেতে হচ্ছিল। তখনই মাথায় এল আকাশ কুসুম কল্পনা, ‘আহা, এমন যদি হতো, একটা বোতাম বা সুইচ টিপলাম, সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়াল! সেই স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে একটা অ্যাপ তৈরি করলেন, যা দিয়ে কয়েকটি শহরে অভিজাত কালো ট্যাক্সি ডাকা যায়। অ্যাপসের মাধ্যমে উবারের গাড়িকে ডাকলে কাছাকাছি অবস্থিত গাড়ি চলে আসবে। যাত্রী গুগল ম্যাপে গাড়ির অবস্থান দেখতে পাবে। সুতরাং গাড়ি আসতে কতক্ষণ লাগবে তা আন্দাজ করতে পারবে। গাড়ির ভাড়া ওই এলাকায় ওই সময়ে গাড়ি সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে বাড়তে বা কমতে পারে। গাড়ি প্রতি ঘণ্টায় ১৮ মাইলের কম বেগে চললে সময় হিসাবে আর ঘণ্টায় ১৮ মাইলের উপরে চললে মাইল হিসাবে বিল হিসাব করা হয়। যাত্রীর ই-মেইলে বিল পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেকোনো গাড়ির মালিক উবারে নাম লেখাতে পারেন। তার গাড়ি যখন অবসর থাকে তখন যাত্রী নিতে পারে। কিছু বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে পারে। আবার তিনিও অন্য চালকের গাড়িতে যাত্রী হতে পারেন। উবার ট্রাফিক জ্যাম কমাতে সহায়তা করে। কারণ উবারের প্রযুক্তি যাত্রী ও চালকের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। চাহিদা আর সরবরাহের ফাঁক বুঝে মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। ড্রাইভার তার যাত্রী সম্পর্কে এবং যাত্রী চালক সম্পর্কে মন্তব্য দিতে পারে। খুব নিম্নমানের মন্তব্য পেলে সেই যাত্রী বা চালককে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালির্ফোনিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে ভর্তি হওয়া ট্রাভিস (১৯৭৬) ২০০৯ সালে গেরেট ক্যাম্প ও স্ট্যাম্বল উপন যৌথভাবে উবার প্রতিষ্ঠা করেন। উবারের মালিকানায় কোনো গাড়ি নেই। এমনকি কোনো ড্রাইভারও তাদের কর্মচারী নয়। অথচ তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ যানবাহন সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের জন্য অন্য কেউ গাড়ি ক্রয় করেনি। বিদ্যমান গাড়িগুলোর অব্যবহূত সময় ও আসন ব্যবহার বাড়িয়ে উবারের ব্যবসা। প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা বাড়ানো মানে যেখানে বোঝে সম্পদ বাড়ানো, সেখানে উবার বা এয়ারবিএনবি সম্পদের ব্যবহার বাড়ানোই কৌশল হিসেবে নিয়েছে।
এদের মধ্যে আরেকটি মিল— তারা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ডের আর্থিক সহায়তা পেয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। আমার এক বন্ধু বলছিল, এরা যে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে ফান্ড পেলেন, এখানে উদ্ভাবন বা ইনোভেশন কোথায়! ইনোভেশন বলতে আমরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে বুঝি। ভাবি, মেশিন থাকতে হবে, ল্যাবরেটরি থাকতে হবে। বৈজ্ঞানিক কোনো ফর্মুলা বাতলে দেবে। অথবা নতুন কোনো গ্রহ বা অণু-পরমাণুর সন্ধান দেবে। উদ্ভাবকের পরনে অ্যাপ্রোন থাকতে হবে। আসলে কি তা-ই? পেপালের প্রতিষ্ঠাতা ও ফেসবুক, লিঙ্কড-ইনসহ কয়েকশ নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগকারী পিটার থেইল বলেছেন, “প্রযুক্তি বলতে শুধু কম্পিউটার বুঝব কেন? একটু গভীরে তাকালে বুঝি, যেকোনো ‘নতুন ও উত্তম উপায়ে কার্য সমাধান’ প্রক্রিয়াই প্রযুক্তি।”
জেফ বেজোস ১৯৯৪ সালে ওয়াল স্ট্রিটের চাকরি ছেড়ে অ্যামাজন প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দোকান স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৫ সালে অনলাইন স্টোর স্থাপন করেন। প্রথমে সিডি, বই, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ভিডিও, পার্টস— এমন ২০টি আইটেম নির্ধারণ করেন বিক্রির জন্য। তার মধ্য থেকে বই দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। কারণ বইয়ের চাহিদা জগত্ব্যাপী আর সরবরাহ মিলবে কয়েক লাখ। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ইংগ্রাম বুকের জন ইংগ্রামের সঙ্গে যুক্তি করে খুলে দিলেন বুক স্টোর। প্রথম দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেট এবং ৪৫টি দেশে বিক্রি করলেন। প্রতি সপ্তাহে বিক্রি দাঁড়াল ২০ হাজার ডলার। ইট কাঠের বইয়ের দোকানে যেখানে সর্বোচ্চ লাখ দুয়েক বই পাওয়া যেত, সেখানে অ্যামাজনে মিলত কয়েক গুণ বেশি। কারণ গুদামের ঝামেলা নেই। কম্পিউটারের অসীম ধারণক্ষমতার সঙ্গে ইট-কাঠের দোকান যে নস্যি। ২০১৫ সালে রেভিনিউ দাঁড়াল ১০৭ বিলিয়ন ডলার, লাভ ৫৯৬ মিলিয়ন ডলার আর কর্মী সংখ্যা ২ লাখ ৬৮ হাজার ৯০০। অ্যামাজন ১৯৯৭ সালে আইপিওতে যায়। ২০০১ সালে প্রথম লাভের মুখ দেখে। অবশ্য বিক্রি তখন ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অ্যামাজনের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। মেশিন ইন্টেলিজেন্স ও গ্রাহক অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অ্যামাজন গ্রাহকের আচরণ বুঝে ব্যবস্থা নেয়। ব্যবসা এখন ‘সম্পদভিত্তিক’ থেকে ‘জ্ঞান ও যোগাযোগভিত্তিক’-এ রূপ নিয়েছে।
উপরোক্ত ব্যবসাগুলোয় লাখ লাখ গ্রাহকের তথ্য সংগৃহীত হয়। সেই তথ্য মেশিন ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে গ্রাহকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। আপনি বিদেশ ভ্রমণে যাবেন। যদি এয়ারবিএনবির মাধ্যমে আবাসিক ব্যবস্থার সুলুক সন্ধান করেন, তাহলে ওই শহরের ব্যাপারে আপনাকে এয়ারবিএনবি প্রতিনিয়ত খোঁজখবর দিতে থাকবে। আপনি ‘চালডাল’-এ কোনো একটা পণ্যের দাম জানতে চাইলেন— ইন্টারনেটে ঢুকলেই আপনি দেখবেন, চালডাল আপনার পেছনে লেগে আছে। কিংবা ডক্টরোলার মাধ্যমে আপনি কোনো ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করিয়েছেন, পরবর্তীতে আপনার উক্ত রোগের ব্যাপারে বিভিন্ন টিপস আপনার কাছে আসতে থাকবে। প্রযুক্তি এখানে বিশাল তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহে আর দ্রুত প্রক্রিয়াকরণে বিরাট ভূমিকা রাখে। আর অবদান আছে নেটওয়ার্কের— যত বেশি লোক কোনো প্লাটফর্মে যুক্ত হবে তথ্যের মান তত উত্তম হবে। সি টু সি বা গ্রাহক টু গ্রাহক রীতির ফলে গ্রাহক বেড়ে গেছে বহুগুণ। পুরনো ধারণায় আগে বিক্রেতাই শুধু বিক্রয় করতেন, এখন ক্রেতাও বিক্রেতা সাজতে পারেন। এয়ারবিএনবির মাধ্যমে আপনি শুধু অন্যের বাসায় থাকা নয়, নিজেও আপনার বাসা ভাড়া দিতে পারেন কোনো পর্যটকের কাছে। উবারে আপনি কখনো যাত্রী আবার কখনো ড্রাইভার বনতে পারেন। গ্রাহক হয়ে যায় সরবরাহকারী আবার সরবরাহকারী বনে যায় গ্রাহক। আলিবাবায় আপনি পণ্য শুধু কেনা নয়, বিক্রিও করতে পারেন। বিদেশ না গিয়েই বিদেশী কোনো পণ্য (বৈদেশিক মুদ্রা আইনসাপেক্ষে) কিনতে পারেন। কিংবা দেশে বসেই আপ-ওয়ার্কের মাধ্যমে আপনার শ্রম, সময় ও মেধা নিয়োগ করতে পারেন বিদেশী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য। ২০ বছর আগেও ব্যবসা এভাবে হতো না। এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। মাত্র নয় বছর আগে মোবাইল সেট বিক্রয় বাজারের ৪১ শতাংশ দখলকারী নকিয়া বিক্রি হয়ে গেছে মাইক্রোসফটের কাছে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। ১৯৭৬ সালে আমেরিকার ফিল্ম বাজারের ৯০ শতাংশ এবং ক্যামেরা বাজারের ৮৫ শতাংশ দখলকারী কোডাক ১৯৯৬ সালে ১৬ বিলিয়ন বিক্রয় আর ১৯৯৯ সালে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করেছিল। অথচ ২০১৫ সালে লোকসান দিয়েছে ২১১ মিলিয়ন ডলার। তাই গতানুগতিক ব্যবসা যারা করছেন, সিট বেল্ট বাঁধুন। আরো কত কিছু আছে সামনে! চোখ-কান খোলা না রাখলে ‘কোডাক’ বা ‘নকিয়া’ বনে যাওয়া অসম্ভব নয়।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিডি ভেঞ্চার লিমিটেড