কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠায় বেকারত্ব হ্রাস

কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠায় বেকারত্ব হ্রাস

  • রিয়াজুল হক

পরিবর্তনের হাওয়া সবখানে। নিজেদের প্রয়োজনেই এই পরিবর্তন দরকার হয়। জমির গুণাগুণ বিচার-বিশ্লেষণ না করে বীজ ফেলেই ফসল উৎপাদন করা হবে, বিষয়টি এখন অনেকটা সেকেলে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা সবকিছুর জন্য প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে। তবে লেখাপড়া না জানার কারণে অনেক কৃষক সেই গবেষণালব্ধ ফল গ্রহণ করতে পারছেন না। জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত আমাদের এই দেশে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমেই কমে আসছে। এছাড়া কৃষিজমি খণ্ড-বিখণ্ড এবং তা সাধারণত ছোট আকারের। এছাড়া যৌথ পরিবার দিন দিন ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরিত হওয়ায় জমিগুলো আরো ক্ষুদ্রতর খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহূত না হওয়ায় এখনো চাষাবাদ একটি অধিক শ্রমসাধ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত। অতীতে যেসব পরিবার চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, বর্তমানে সে পরিবারগুলোর সন্তানরা শহরে এসে চাকরি করছে এবং গ্রামে নগদ টাকা পাঠিয়ে তাদের সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছে। তারা মনে করে, চাষাবাদ একটি কষ্টকর এবং অসম্মানজনক পেশা। ছেলেমেয়েদের ইচ্ছায় এমন পরিবারের অভিজ্ঞ কৃষকরা ধীরে ধীরে চাষাবাদ বাদ দিয়ে তাদের জমি বর্গাচাষের মাধ্যমে আবাদ করাচ্ছে। বেশির ভাগ বর্গাচাষী আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং নিরক্ষর। তাদের অধিকাংশেরই বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে চাষাবাদ-সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদের ফলে বর্গাচাষীদের অনেকেই বছরে একবার ফসল উৎপাদন করে আর্থিক অবস্থার একটু উন্নতি হলে পরের বছর বা পরবর্তী মৌসুমে ফসল উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে জমিটি পতিত রয়ে যায়। বর্তমানে কৃষক এবং বর্গাচাষীরা বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও থেকে কৃষিঋণ গ্রহণ করলেও সেগুলো সুপরিকল্পনার অভাবে অনেক সময়ই সঠিকভাবে কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারে না। সাংসারিক অভাব-অনটন এবং পরিকল্পনার অভাবে অনেক সময়ই কৃষিঋণের অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করে ফেলেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের ফলে অনেক সময় চাষীরা রবি মৌসুমে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় চাষাবাদে অনীহা দেখান। ফলে জমি থেকে সঠিক পরিমাণ ফসল উৎপাদন অনেক সময়ই সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য জমি থেকে সঠিক পরিমাণ ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুপরিকল্পিত চাষাবাদ, কৃষি ফসল উৎপাদন-ভিত্তিক শিল্প এবং কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ফসলের প্রকৃত মূল্য পান, তার বাজারজাতের ব্যবস্থা গ্রহণ। বাংলাদেশে দারিদ্র্য আজো ব্যাপক বিস্মৃত। মৌলিক খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছে শ্লথগতিতে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও দ্রুত সম্প্রসারণশীল শহরায়ণের কারণে জনগণ এখন চাইছে রকমারি উন্নত মানের খাদ্য এবং সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, যা একজন ব্যক্তি কৃষকের জন্য সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব। প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিনির্ভর সাংগঠনিক বিনিয়োগ।

বর্তমানে দেশে বেশকিছু প্রসিদ্ধ কোম্পানি যেমন— আকিজ, স্কয়ার, এসিআই কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করছে এবং দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মাফিক বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত করছে। অনেক কোম্পানি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কৃষিপণ্য সংগ্রহ করছে। তবে এখন পর্যন্ত কৃষি ফসল উৎপাদনে সরাসরি কোনো বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। ব্যক্তি ও পারিবারিক উদ্যোগে কিছু কিছু ফলমূল ও সবজি উৎপাদন এলাকা গড়ে উঠলেও বৃহত্ পরিসরে গড়ে ওঠেনি কোনো সুপরিকল্পিত কৃষি ফসল উৎপাদনমুখী ফার্ম। ফলে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কৃষক এবং বর্গাচাষীরাই ভরসা, যাদের উৎপাদনের হার কম।

base_1481515141-reyazul-haque20161111095415
রিয়াজুল হক

কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ উৎপাদন কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যে এলাকার জন্য যে ফসল উপযোগী, সেসব এলাকায় বড় বড় ফার্মের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কৃষি ফসল উৎপাদন করা হয়। ইউএসডিএ পরিচালিত এক জরিপ মোতাবেক, আমেরিকার মোট কৃষি ফার্মের সংখ্যা ২১ লাখ ৯ হাজার ৩৬৩, যাদের প্রতিটির গড় জমির পরিমাণ ৪৩৪ একর। মোট ফার্ম সংখ্যার মধ্যে যেমন এক হাজার একর বা তার অধিক আকারের বৃহত্ ফার্ম রয়েছে, তেমনি এক থেকে নয় একরের ক্ষুদ্র ফার্মের পাশাপাশি ১০-১০০ একরের মাঝারি আকারের ফার্মও রয়েছে। আমাদের দেশে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রতিটি উপজেলায় মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করে সে অনুযায়ী কৃষকদের ফসল উৎপাদনে পরামর্শ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কৃষকরা এখান থেকে সুবিধা নিতে অভ্যস্ত নন। তারা তাদের চাহিদা মোতাবেক অধিকাংশ এলাকায় খাবারের জন্য ধান এবং জ্বালানির প্রয়োজনে পাট চাষে অভ্যস্ত হয়ে আছে। বর্তমানে ব্যক্তিপর্যায়ে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন শাকসবজিও ফলমূল আবাদ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশে কৃষি উৎপাদন ফার্ম গড়ে উঠলে পরিকল্পিতভাবে মাটির গুণাগুণ অনুসারে খণ্ড খণ্ড জমিগুলো একীভূতকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে এবং উৎপাদন আরো বৃদ্ধি হবে। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণও অনেকাংশে সহজ হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি লিজ নিয়ে যেমন বড় বড় মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে, তেমনই অন্যান্য এলাকায়ও এরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করে কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। একই এলাকার আশপাশের খণ্ড খণ্ড জমির মালিকদের নিয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি গঠন করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কৃষি ফার্ম গঠন করে সমন্বিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যেতে পারে। জমির মালিকদের কাছ থেকে বছরভিত্তিক লিজ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত কোনো সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষি ফার্ম গঠন করা যায়। নতুন নতুন এনজিও এবং কোম্পানি প্রতিষ্ঠাপূর্বক তাদের মাধ্যমে কৃষি ফার্মভিত্তিক চাষাবাদের উদ্যোগ নেয়া হলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেক সহজ হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী জমি লিজ হতে প্রাপ্ত অর্থের পাশাপাশি এসব ফার্মে কাজ করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে। ফার্মের কাজের বাইরে বাকি সময়ে নিজের কাজ করলে অর্থনীতিতে ছদ্মবেশী বেকারের হারও হ্রাস পাবে। তবে এনজিও এবং কোম্পানিগুলো যাতে জবরদখল করে কৃষকদের জমি না নেয় এবং সময়মতো লিজের টাকা পরিশোধ করে, সে বিষয়ে প্রশাসনিক কঠোর আইন ও তার বাস্তব প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ফার্মে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নেয়ার পাশাপাশি বৃহত্ ফার্মে বা কয়েকটি ছোট ছোট ফার্মকেন্দ্রিক একজন করে কৃষিবিদ নিয়োগ করলে ফার্মভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা কৃষি খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। ফলে কৃষিকাজের সামাজিক মর্যাদাও বাড়বে এবং শিক্ষিত বেকার শ্রেণীকে চাকরি হিসেবে কৃষি খাতে নিযুক্ত করা সম্ভব হবে। কারণ একজন শিক্ষিত বেকার মাঠে চাষাবাদের বদলে একই কাজ প্রতিষ্ঠিত কৃষি ফার্মে করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। ফার্মে জনসাধারণের কর্মসংস্থানের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি সাধন হবে এবং নগরায়ণ সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি এসব ফার্মে ঋণ প্রদানপূর্বক কার্যকর কৃষিঋণের পরিমাণও অনেক গুণ বাড়াতে পারবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের পাশের দেশগুলোয় অনেক কৃষি ফার্ম গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশের জমির মালিকপক্ষ, ফার্ম পরিচালনাকারী কোম্পানি বা এনজিও, প্রশাসন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমন্বয় করে কৃষি ফার্ম গঠন কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও উদ্যোগ গ্রহণ করলে, তা অবশ্যই সম্ভব। এরূপ কয়েকটি ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে লাভের মুখ দেখলে বড় এবং মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠান কৃষি ফার্মভিত্তিক বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। সময়ের প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষিত বেকারত্ব হ্রাসে কৃষি ফার্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ (বর্তমান বাজারমূল্য ২৪ লাখ ২২ হাজার ৯০২ মিলিয়ন টাকা, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯২ মিলিয়ন টাকা)। জিডিপিতে কৃষির অবদান আরো বৃদ্ধি সম্ভব। কৃষি ফার্মের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং শিক্ষিত বেকারের হারও হ্রাস পাবে।

লেখক: উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সূত্র: বণিক বার্তাfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment