উদ্যোক্তা উন্নয়নের স্বপ্ন ও বাস্তবতা
- মারুফ রেজা বায়রন
সাম্প্রতিক সময়ে পেশা নির্বাচনে আমাদের দেশে এক ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। চাকরি করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে নিজে কিছু একটা করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠছে তরুণ সমাজ। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব মহলের কথা ও কাজে উদ্যোক্তা সৃষ্টির তত্পরতা লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়ছে। বর্তমান সরকার নির্ধারিত ‘ভিশন ২০২১’ অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের রূপকল্প অর্জনে এ নতুন মানসিকতা বড় ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করছেন। সমাজের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে উদ্যোক্তা উন্নয়নকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা দিন দিন প্রসার হচ্ছে। এক কথায় বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির উত্সাহ ক্রমেই সক্রিয় এক সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামো কি নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির এ জোয়ারকে ধারণ করতে সক্ষম? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির এ গণজাগরণকে দিকনির্দেশনা দিতে প্রস্তুত? আমাদের আইনি কাঠামো বা আর্থিক ব্যবস্থাপনা কি তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার উপযুক্ত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২৬ লাখ ৩১ হাজার বেকার, যারা সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করারও সুযোগ পান না। গত দুই বছরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ছয় লাখ। অথচ দুই বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার। এসবই সরকারি হিসাব। প্রকৃত অবস্থা এর চেয়েও নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। এ বাস্তবতায় দাঁড়িয়েই আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উত্তরণে একটি সুসংহত ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সরকারি-বেসরকারি সব মহলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই একটি কার্যকর, বাস্তবমুখী, ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এখন তাই সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অন্য এক হিসাবমতে, বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সংখ্যা ৭০ লাখ, যার ৯০ শতাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির্নিভর। গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এসব ক্ষুদ্র উদ্যোগের সঙ্গে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ খাতের অংশগ্রহণ আরো বাড়ানো সম্ভব, যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার চলমান সরকারি উদ্যোগকে আরো বেগবান করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। পাশাপাশি শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত তরুণদের দ্বারা পরিচালিত ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর মেধাশ্রমভিত্তিক শিল্পোদ্যোগকে কীভাবে বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থানে নেয়া যায়, সে ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি তথা উদ্যোক্তা উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে উদ্যোক্তাদের ব্যাপক সামাজিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা দরকার। একটি উদ্যোক্তাবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। আমাদের দেশে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে আর অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরাই ব্যবসা করবে। এমনকি কিছুদিন আগ পর্যন্তও এমন ধারণা শক্তিশালী ছিল যে, তুমি যদি ব্যবসাই করবে, তবে এত কষ্ট করে লেখাপড়া করার কী দরকার ছিল। তবে সময় বদলাচ্ছে, তার সঙ্গে পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষের মনোভাব ধীরে হলেও বদলাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া আমাদের তরুণদের চোখে নতুন দিনের স্বপ্ন এঁকে দিচ্ছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি চাকরির সনাতন পথে পা না বাড়িয়ে নিজে কিছু একটা করতে এখনকার তরুণদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। নিজেদের ভবিষ্যত্ গড়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে ভূমিকা রাখার তাগিদ থেকে তরুণরা নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছে। তারুণ্যের এ জেগে ওঠা শক্তিকে জোয়ারে পরিণত করতে এখন প্রয়োজন যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সমর্থন। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিটি পর্যায় থেকে শর্তহীন অনুপ্রেরণাই পারে দিনবদলের এ চালিকাশক্তিকে গতিশীল করতে। আমরা যদি আমাদের তরুণদের মেধা কাজে লাগাতে পারি, যদি তাদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারি, তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এ তরুণ উদ্যোক্তারাই বিশ্ব অর্থনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশের পতাকাকে সগর্বে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে।
বাংলাদেশে উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতাগুলো দূর করা একান্ত কাম্য। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর-প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় সাধন করা দরকার। উদ্যোক্তারা যেন এক জায়গা থেকে সব ধরনের সেবা পেতে পারে, সেজন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিসের ব্যবস্থা করা জরুরি। ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা উদ্যোক্তাবান্ধব হওয়া উচিত। প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে আরো বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এটা সত্য যে, শুধু বই পড়ে উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। কিন্তু বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনা ছাড়া সফল উদ্যোক্তা হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই দেশ-বিদেশের নতুন নতুন উদ্ভাবন সম্পর্কে আলোচনা করা, উদ্যোক্তা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করা, তরুণ উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বীয় জ্ঞান প্রদানের জন্য ইনোভেশন হাব বা এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ একাডেমি গড়ে তোলা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোর্স চালু করা এখন সময়ের দাবি। কারণ উদ্ভাবনী-সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া উদ্যোক্তা উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
আমরা সবাই জানি, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে পারলে দেশের অর্থনীতিকে পাল্টে ফেলা সম্ভব। কিন্তু তার জন্য যে সার্বিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দরকার, সেটা ছাড়া কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করা যাবে না। পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটি সুসমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার সুসময় যে এখনই, সেটা মনে হয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি