কৃষি জমি কমলেও বাড়ছে উৎপাদন
- দিনেশ মাহাতো
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপর আমরা অনেকটাই নির্ভরশীল। আমাদের দেশে জনসংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বাড়ছে খাদ্য চাহিদাও। তারপরেও দেশের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য রফতানি হচ্ছে এখন। কয়েক দশক আগেও যা আমরা ভাবতে পারতাম না। বাংলাদেশকে একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। কিছু এলাকাকে মঙ্গাকবলিত এলাকা বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে এ কথাগুলো বিলুপ্তপ্রায়। কেননা দেশে এখন মঙ্গা বলে কিছু নেই। দেশে কেউ না খেয়ে মরে না। আর সবকিছুই সম্ভব হয়েছে আমাদের কৃষক ও কৃষির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার মেধা শ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টায়। প্রতিনিয়ত কৃষি জমি কমছে আমাদের দেশে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৬ একর জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। এ খাতে চলে যাওয়া জমির মধ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৪ হাজার ৪৮৯ একর জমিতে। দোকান নির্মাণ হয়েছে ৬ হাজার ২৬২ একর জমিতে। বাকি জমিগুলোতে কল কারখানাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (এসআরডিআই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কৃষি জমি বিলুপ্তির প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার একর। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চাষ যোগ্য জমি রয়েছে মাত্র ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। দেশে যে শুধু কৃষি জমিই কমছে তা নয় কমছে কৃষি পরিবারের সংখ্যাও। ১৯৮৩-৮৪ সালে গ্রামঞ্চলে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭২ দশমিক ৭০ শতাংশ। এই সংখ্যা ১৯৯৬ও ২০০৮ সালে কমে যায় যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ১৮ শতাংশ ও ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্য যে কোন কাজের চেয়ে কৃষি কাজে শ্রম বেশি দিতে হয় আবার অনেক সময় ফসলের সঠিক মূল্যও পায় না কৃষক।
এসব বিভিন্ন কারণে গ্রামের অনেক কৃষক ধান উৎপাদন কমিয়ে সবজি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কেননা ধান চাষের চেয়ে সবজি চাষ কিছুটা বেশি লাভজনক। পাশাপাশি বাড়ির আশপাশে খালি জায়গা এখন পড়ে থাকতে দেখা যায় না, সেখানে নানা ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে । ফলে দেশে সবজি উৎপাদন এখন বেড়েছে কয়েকগুণ। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নত জাতের ধান আবিষ্কারের ফলে বেড়েছে ধানের উৎপাদন । তাছাড়া একসময় দেখা যেত পানির অভাবে মাঠের ধান মারা যাচ্ছে। এখন এমন ঘটনা প্রায় বিরল কেননা বিকল্প পদ্ধতিতে সেচের ব্যবস্থা রয়েছে প্রায় সবখানে। রাস্তার আশেপাশে কয়েক দশক আগেও মাঠের পর মাঠ ফাঁকা দেখা যেত। এখন এগুলো সবুজের সমারোহ। এছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের মাঠের পুকুরপাড়গুলোতে আগে কোন ফসল চাষ হতো না। এখন সেগুলোতে টমেটো, বেগুন, মরিচসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হচ্ছে। গ্রামের বাড়ির পুকুরগুলোতে আগে শুধু নিজ বাড়িতে খাবার মতো মাছ চাষ হতো।এখন গ্রামেও প্রায় প্রতিটি পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।
কৃষির প্রতি বর্তমান সরকারের রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। কৃষকদের বিভিন্ন ঋণ সুবিধা দেয়া, সার, বীজের সঠিক সরবরাহ ও কৃষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। তাই তো দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রফতানি হচ্ছে। আর এ রফতানি থেকে বছরে আয় হচ্ছে ৬৫০ কোটি টাকা। যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। তাছাড়া দেশে এখন পাকা রাস্তা অনেক বেড়েছে। তাই খুব অল্পসময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে যে কোন সবজি বা ফল পৌঁছে যাচ্ছে খুব অল্পসময়ে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে বিভিন্ন জাতের ধান, ফল, সবজির চাষ। দেশে প্রায় ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপ্লব ঘটিয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এতে বদলে গেছে প্রান্তিক কৃষকের জীবনযাত্রার মান, ঘুরে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা। বাংলাদেশের কৃষকের সাফল্য ও পরিশ্রম করার মানসিকতা সবাইকে অবাক করেছে। আমাদের দেশে কৃষি জমি ব্যাপকহারে কমলেও বাংলার কৃষক অল্প জমিতে বেশি ফসল ফলিয়ে খাদ্য চাহিদা পূরণ করে চলছে।