উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি শিক্ষা
- হায়দার আহমদ খান
সমপ্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখন ১১ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ। গতবছরের তুলনায় ২০১৬ সালের অগ্রগতি মাত্র শূন্য দশমিক সাত শতাংশ। সরকারের দাবি, বাংলাদেশের গড় সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। উন্নয়ন এবং অঞ্চলভেদে উন্নয়ন চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশ সরকারের স্ট্যাটিসটিক্যাল ইয়ার বুক-২০১৪-এ প্রকাশিত ২০১১ সালের হিসাবে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৫৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। সাক্ষরতা হলো পড়া, লেখা অঙ্ক কষতে পারার সক্ষমতা।
অন্য এক সংবাদে দেখা যায়, বাংলাদেশের বেকারদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারা। বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতেই কর্মসংস্থান বেশি সৃষ্টি হওয়ার কথা। বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত মানবসম্পদ। মানবসম্পদ সৃষ্টি হয় শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। সরকারের দাবি এক কোটি ৯৩ লাখ ছেলে-মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় সম্পৃক্ত। শুভ সংবাদ। গত বছর ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ছেলেমেয়ে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় নিবন্ধন এবং প্রবেশপত্র সংগ্রহ করেছিল। বছরভিত্তিক অর্থনীতির সূত্রে কোনো এক বছর ৩২ লাখ ৪৩ হাজারের অধিক ছেলেময়ে কর্মজগতে প্রবেশ করবে। উপযুক্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজ যদি তাদেরকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে না পারে, তাহলে সমাজে কি প্রভাব পড়বে বা দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনার ফলাফল কী হবে? মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা কোনো অবস্থায় সমাজের দায় নিবে না। এখানে জাপানের বেসরকারি ব্যবসায়ীদের একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১২ সালে জাপানের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল এসেছিল বাংলাদেশে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে। এফবিসিসিআই-এর সঙ্গে আলোচনায় আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল বক্তব্য রাখার এবং শোনার। জাপানী প্রতিনিধিদলের একজনের বক্তব্য ছিল ‘গারবেজ (garbage) উত্পাদনের জন্য কি আমরা বিনিয়োগ করব? টাকা, মেশিনের সঙ্গে যদি মানুষও জাপান থেকে আনতে হয় তাহলে বাংলাদেশে কেন বিনিয়োগ করব আমরা?’ আসলেই সব কিছুর জন্য প্রয়োজন মানবসম্পদ। এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ বিদেশি আইনি-বেআইনিভাবে কর্মরত আছে। আমাদের শিক্ষিত ছেলেরা বেকার। অন্যদিকে শ্রমিকের চাকরি নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে এক কোটির উপর যুবক। এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ছয় কোটি সাত লাখ, তার মধ্যে চার কোটি বেকার। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স’ ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার।
কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন সুস্থ, সুন্দর ব্যবসায়িক পরিবেশ। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সব কিছু চলে আসছে ব্যবসাখাতে। কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা মূলধন। দেশে মূলধনের বড় অভাব। মূলধন সংগ্রহে বহির্বিশ্বের দ্বারস্থ হতে হবে ঠিকই; সঙ্গে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। ঋণদাতাদেরও প্রধান উদ্দেশ্য থাকে নিজ নিজ দেশের স্বার্থ। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড: এশিয়া, প্যাসিফিক অ্যান্ড দ্য আরব স্টেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ শিক্ষায় নেই, চাকরি করছে না, আবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছে না।
একটি সমাজের বড় সম্পদ তার তরুণ সম্প্রদায়। সেই তরুণ সম্প্রদায়ই যদি থাকে নিষ্ক্রিয়, তাহলে সমাজের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব হবে? জাতিসংঘের ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) নামক পরিকল্পনার ১৭টি গোল বা লক্ষ্য অর্জনের মিছিলে শরিক হতে পারব আমরা?
বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানে ছাড় দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনায় আছে উন্নতি। বাস্তবে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনার শতভাগ অর্জন। মনে রাখতে হবে একটি দেশের যুবক সম্প্রদায় উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। যুবক সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থানের সুফল বহুবিধ। আমরা আশাবাদী।
লেখক : চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশান-ইডিএ