ইঁদুরের কাছে মানুষের পরাজয়
- সব্যসাচী দাস রুদ্র
পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব বা আন্দোলন খুব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একটু বইপত্র ঘাটলেই পাওয়া যাবে মানুষের বিপ্লব সংক্রান্ত সব তথ্য। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই মনুষ্যজাতির অন্তর্বতী কলহ। কিন্তু কখনো ভেবেছেন যে ইঁদুরের বিরুদ্ধেও বিপ্লব সম্ভব? হ্যাঁ এমনটাই হয়েছিল তৎকালীন ইন্দোচীন অর্থাৎ বর্তমানের কম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনাম নামে পরিচিত দেশগুলোতে।
ইন্দোচীন তখন ইউরোপের ফ্রান্সের অধীনে শাসিত হতো। ইন্দোচীনের রাজধানী হিসেবে তৎকালীন ফরাসী সরকার ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরকেই নির্বাচন করেন। ফরাসীদের পরিকল্পনা ছিল যে তারা হ্যানয়কে বানাবেন ফ্রান্সের আদলে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ১৮৯৭ সালে পল ডুমারকে ইন্দোচীনের গভর্নর জেনারেল হিসেবে যোগদান করানো হয়। পল ডুমার হ্যানয় শহরকে আধুনিক বানাতে শুরু করেন ফরাসী পদ্ধতির অতি উন্নত স্থাপনা নির্মাণ।
কিন্তু ইন্দোচীনের মানুষদের আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা ছিল একদমই কম। মাটির নিচের বিশাল পাইপ দিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশনের পদ্ধতি তাদের জানাই ছিল না। তারা সকল ময়লা নদীতে গিয়ে ফেলে আসত। পল ডুমার এই জিনিসটা পরিবর্তন করার জন্য উঠে পরে লাগলেন। তবে পল ডুমার যখন গভর্নর পদ ছেড়ে দেন তখন মাটির নিচে প্রায় সতেরো কিলোমিটার জায়গায় পাইপ লাগানো হয় এবং বলা হয় ভিয়েতনামে এটাই ছিলো প্রথম ও পরিপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।
এই মাটির নিচের পয়ঃনিষ্কাশন পদ্ধতিই প্রথম ইঁদুরের প্রবল উৎপত্তি হিসেবে বাধ সাধে। এর আগেও ফ্রান্সজুড়ে ইঁদুর একদমই ছিল না তা বললে ভুল হবে। তবে খুব অল্প। নিয়ম মেনে প্রতিকারও করা হতো। তবে ইন্দোচীনের এই মাটি খুড়ে উন্নয়নের ফলে ইদুরের সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুন হয়ে যাওয়ার ফলে ফরাসী ও ইন্দোচীনের জনগণ এর পূর্ণ প্রতিকার খুঁজছিল।
তবে ফরাসী ঔপনিবেশিক সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল এই সমস্যা সমাধানের জন্য। হঠাৎ ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পিছনে মূল কারণ ছিল ওই মাটির নিচের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাই। ওই পাইপগুলোয় প্রচুর ময়লা থাকায় ইঁদুরদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। এবং দ্রুত প্রজননের জন্য ইঁদুর বাড়তে থাকে বিপুলভাবে। এমনকি একসময় এমন অবস্থা হয় যে ময়লার চেয়ে বেশি ইঁদুরের সংখ্যা দেখা যায়।
এই পাইপগুলো সরাসরি সংযুক্ত ছিলো ফরাসী কর্মকর্তাদের বাসায়। এদের বাসায় উন্নত বাথরুম ব্যবস্থা থাকলেও ওখান থেকেই চলে আসতো ইঁদুরগুলো। যা ওই কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের মনে এক ভয় সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ইঁদুরের ভয় এতটাই ভয়ংকর পর্যায়ে গিয়েছিল যে ঔপনিবেশিক সরকারের কর্মকর্তারা ইস্তফা দিয়ে দেয়।
ইঁদুরের জন্য প্রধান যে সমস্যা শুরু হয় তা হলো খাদ্য সংকট এবং মহামারী। এছাড়াও জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া শুরু হয়। হ্যানয়ে ফরাসিদের একটি মেডিকেল কলেজে এও প্রমাণিত হয় যে মাটির নিচের পাইপগুলো থেকে আসা ইদুরগুলোই বুবানিক প্লেগের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না পেয়ে ফরাসি সরকার শক্ত হাতে ইঁদুর প্রতিরোধের জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ইঁদুর মারার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ইঁদুরের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তারাও পেরে ওঠে না। এরপর নতুন পদ্ধতি হিসেবে ভিয়েতনামীদের বলা হয় একটি ইঁদুর মারতে পারলে এক সেন্ট করে দেয়া হবে।
ভিয়েতনামীরা এই ঘোষণা শুনে তড়িঘড়ি করে ইদুর মারতে নামে এবং শর্ত ছিলো মৃত ইদুরের লেজ কেটে পারিশ্রমিক সেন্ট কড়ায় গণ্ডায় নিয়ে নিবে জনগণেরা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে তারা ইঁদুর না মেরে শুধু জীবিত ইঁদুরদের লেজ কেটেই নিয়ে আসছে।
শেষরক্ষা আর হয়নি হ্যানয়বাসীদের। তারা হেরে যায় ইঁদুরের মতো এক ছোট্ট প্রাণীর কাছে। অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় হ্যানয়বাসী। প্রকৃতির নিয়মে ইঁদুররা চলে না যাওয়া পর্যন্ত এই ক্ষতি অব্যহত থাকে।