সিংহের ডেরায় বাঘের হুংকার
- তৌহিদুল ইসলাম
আকাশের দিকে দু হাত উঁচিয়ে কি হুংকারটাই না ছুঁড়লেন মুশফিকুর রহিম! প্রায় ৩০ হাজার দর্শকে ঠাসা গ্যালারি স্তব্ধ। সিংহের ডেরায় যেন বাঘের হুংকার! এ হুংকার যেন শত প্রশ্নের উওরও। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলটির পাল্টা জবাব দেওয়ার চিৎকার। অসাধারণ এক জয়ের আনন্দ-চিৎকার।
এশিয়ার মধ্যে রান তাড়া করে জয় পেয়ে ইতিহাস গড়ে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।এর আগে রেকোর্ডটি ছিল ভারতের দখলে। শনিবার প্রেমাদাসার আকাশের মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে লংকাদের চোখে, বাংলাদেশ জিতেছে ৫ উইকেটে।
বাংলাদেশ সফরে শেষ খেলায় ২১০ রান তুলেছিল শ্রীলঙ্কা। প্রেমাদাসায় সেটিকে ছাপিয়ে তারা তোলে ২১৪ রানেরর পাহাড় সমান রান। এতো বড় পাহাড় আগে টপকাতে পারেনি বাংলাদেশ। ১৬৪ রানের বেশি তাড়া করে জেতা হয়নি কখনো। এরমধ্যে সাম্প্রতিক ফর্ম, আশার পালে হাওয়া লাগাতে পারেনি। যতই আহত বাঘ হোক না কেন লড়াই ছাড়া পিছু হটবে কি সে? পিছু হটেনি বাংলার এগারো টাইগারাও। ফলও এসেছে হাতেনাতে। অবিস্মরণীয় ম্যাচে বাংলাদেশ জিতল দুই বল বাকি রেখে।
ঝড়ো শুরুতে দলকে জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে তামিম ইকবাল ও লিটন দাসেরর চওড়া ব্যাট। বাকিটুকু মুশফিকময়। বীরোচিত ব্যাটিংয়ে দলকে জিতিয়ে লিখলেন নতুন এক অধ্যায়। শেষ কয়েক ওভার খুঁড়িয়েছেন, পায়ে নিয়েছেন ক্র্যাম্প কিন্তু মুশফিক হাল ছাড়েননি। হয়তো অদৃশ্য কোনো শক্তিকে দিতে চেয়েছেন জবাব।
বড় রান তাড়া করার প্রথম শর্ত দারুণ শুরু। শ্রীলঙ্কা পঞ্চাশ স্পর্শ করে ৩.৫ ওভারে। বাংলাদেশের সেখানে দুই বল বেশি লাগে। পাওয়ার প্লে বেশ ভালো কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ। ৬ ওভারে শ্রীলঙ্কার রান ছিল ১ উইকেটে ৭০, বাংলাদেশের ১ উইকেটে ৭৪।
তিন অঙ্ক আসে ৯.২ ওভারে। যেখানে লঙ্কানদের শতরান ছিল ১০.২ ওভারে। দেড়শতেও বাংলাদেশ এগিয়েছিল এক ওভার। অতীতে কাছে গিয়ে পথ হারিয়েছে অনেক, তবে এবার শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছে।
ডানহাতি-বাঁহাতি কম্বিনেশন ছিল বেশ। দুজন এনে দেন কাঙ্ক্ষিত ভিত, ড্রেসিং রুমে ছড়িয়ে দেন আত্মবিশ্বাস, প্রতিপক্ষকে ফেলে দেন চাপে।
লিটন শুরুটায় একটু নড়বরে হলেও খানিকবাদে সামলে নেন নিজেকে খেলেছেন দারুণ সব শট। ফ্লিক শটগুলো ছিল দৃ্ষ্টিনন্দন, চোখধাঁধাঁনো। তামিমও ছিল চেনা চেহারায়।
৫ ছক্কায় ১৯ বলে ৪৩ করে লিটন আউট হন নুয়ান প্রদিপের স্লোয়ারে। ততক্ষণে স্কোর বোর্ডে রান ৭৪।
২৯ বলে ৪৭ রানে থিসারা পেরেরার কাছে বন্দি হন তামিম। গত ১৩টি টি-টোয়েন্টিতে তার সর্বোচ্চ স্কোর এটি।
সৌম্যর শুরুটা ছিল নড়বড়ে। তবে উইকেট বিলিয়ে দেননি। আরেক পাশে মুশফিক শুরু থেকেই ছিলেন দুর্দান্ত। বাংলাদেশ তাই পেয়ে যায় আরেকটি অর্ধশত রানের জুটি।
২২ বলে ২৪ করে সৌম্য ফিরেছেন। ১১ বলে ২০ রানের কার্যকর ইনিংস খেলেন মাহমুদউল্লাহ। শেষের আগের ওভারে রান আউট সাব্বির। ভরসা আলো হয়ে ছিলেন কেবল সেই মুশফিকই।
বেঙ্গালুরুর স্মৃতির কি তবে আবার পুনরায় ফিরবে, উঁকি দিয়েছে অনেকের মনে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে হাতের মুঠো থেকে জয় ফেলে দিয়েছিলেন মুশফিক। এবার কোনো ভুলের পথে পা নয়। শেষের আগের ওভারে ছক্কা মেরে নিয়েছেন ৬ বলে ৯ রানে।
শেষ ওভারের প্রথম বলে দুই, পরের বলে চোখ জুড়ানো বাউন্ডারি। পরের বলে আবার দুই। এরপর সিঙ্গেলে জয়। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে ৩৫ বলে ৭৪ রানে অপরাজিত মুশফিক।
তবে ম্যাচটির প্রথম ভাগে এই দলই ছিল মলিন ছন্নছাড়া, অনেকেই হয়তো টিভিসেট থেকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল মুখ। আগের ম্যাচে বোলিং ভালো হলেও এদিন ছিল এলোমেলো, একদম ধারহীন।
তাসকিন আহমেদের করা প্রথম ওভারেই কুসল মেন্ডিসের ব্যাটে চার ও ছক্কা। দুটির একটিও অবশ্য মাঝ ব্যাটে নয়। তবে খুব দ্রুতই ব্যাটের মাঝ থেকে বল ছুটতে থাকে প্রেমাদাসার নানা প্রান্তে।
মুস্তাফিজের করা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার থেকে ১১। তৃতীয় ওভারে রুবেল হোসেন চার দিয়ে শুরু করেও দেন মাত্র ৬ রান। সেটি পুষিয়ে দিতেই যেন পরের ওভারে উদার হয়ে এগিয়ে আসেন তাসকিন। ওই ওভার থেকে আসে ২২।
২৭ বলে ৫৬ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন মুস্তাফিজ। দারুণ কাটারে বোল্ড করেন ১৯ বলে ২৬ রান করা গুনাথিলাকা।
সেটি ছিল কেবলই ক্ষনিকের স্বস্তি। হাওয়া আবারও বৈরি হয়ে ওঠে দুই কুসলের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে।
স্পিন আক্রমণে আসার পর একটু ভাটার টান ছিল রানের স্রোতে। ৩ ওভারে রান আসে ১৬। তবে সেটি ছিল যেন ঝড়ের আগের শান্ত পরিস্থিতি। আবার উত্তাল হয়ে ওঠে দুজনের ব্যাট।
২৪ বলে কুসল মেন্ডিস স্পর্শ করেন ফিফটি। তার ক্যারিয়ারের তৃতীয়। তিনটিই বাংলাদেশের বিপক্ষে, টানা তিন ম্যাচে।
সপ্তম বোলার হিসেবে আক্রমণে এসে এই জুটি ভাঙেন মাহমুদউল্লাহ। শুরুটা যদিও ছিল বাজে। প্রথম বলটি ছিল শর্ট, মেন্ডিস ফেলেন গ্যালারিতে। পরের চার বলেই তুলে নেন দুই উইকেট।
৫ ছক্কায় ৩০ বলে ৫৭ করে আউট কুসল মেন্ডিস। ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া দাসুন শানাকা শূন্য। দুজনই ধরা মিড উইকেটে সাব্বিরের হাতে।
আরেকটি খরুচে বোলিংয়ের ম্যাচে তাসকিনকে সান্ত্বনার উইকেট উপহার দিয়ে যান দিনেশ চান্দিমাল। তাতে শ্রীলঙ্কার ক্ষতি খুব একটা হয়নি। কুসল পেরেরা ছিলেনই। শেষের দাবি দারুণভাবে মেটান উপুল থারাঙ্গাও।
৪৮ বলে ৭৪ রান করে পেরেরা আউট হন শেষ ওভারে। থারাঙ্গা অপরাজিত ১৫ বলে ৩২ রানে। শেষ ওভারে জিবন মেন্ডিসের ছক্কায় বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের আগের সর্বোচ্চ ছাড়িয়ে যায় শ্রীলঙ্কা।
সর্বোচ্চ ছিল সেটা এই মাঠেরও। কে জানত, ঘণ্টা দেড়েক পরই সেই স্কোর পড়ে যাবে পেছনে! নতুন ইতিহাস রচনা করেই যেন দুঃসময়ের ঘুরপাক থেকে বের হতে চেয়েছিল বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ২১৪/৬ (গুনাথিলাকা ২৬, মেন্ডিস ৫৭, পেরেরা ৭৪, শানাকা ০, চান্দিমাল ২, থারাঙ্গা ৩২*, থিসারা ০, জিবন ৬*; তাসকিন ১/৪০, মুস্তাফিজ ৩/৪৮, রুবেল ০/৪৫, মিরাজ ০/৩১, নাজমুল ০/২০, সৌম্য ০/১১, মাহমুদউল্লাহ ২/১৫)
বাংলাদেশ: ১৯.৪ ওভারে ২১৫/৫ (তামিম ৪৭, লিটন ৪৩, সৌম্য ২৪, মুশফিক ৭২*, মাহমুদউল্লাহ ২০, সাব্বির ০, মিরাজ ০*; চামিরা ১/৪৪, দনঞ্জয়া ০/৩৬, প্রদিপ ২/৩৭, গুনাথিলাকা ০/২২, থিসারা ১/৩৬, অজন্তা ০/২৫, শানাকা ০/১২