সমান সুযোগ তৈরি করা আবশ্যক

সমান সুযোগ তৈরি করা আবশ্যক

মোস্তাফিজুর রহমান: ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড; সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য’ কথাটা হাস্যকর শোনালেও এটাই বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ২০১৫ সালের বাস্তবতা। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে সারা পৃথিবী যখন শিক্ষাকে অধিকতর সহজলভ্য করতে ব্যস্ত, তখন আমরা চলেছি উল্টো পথে। শিক্ষা বিশ্বব্যাপী যখন মৌলিক অধিকার, বাংলাদেশ সরকারের কাছে তা তখন ব্যবসা বিবেচনায় কর আদায়ের উৎস!

সম্প্রতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট, অর্থাৎ ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স আরোপ করে এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে; যা হতাশাজনক। এটা শিক্ষার স্বাভাবিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় বাধা। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করার শামিল, যা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য বড় হুমকি। কর আরোপের খবরটি প্রথম শোনার পর আমার মনে পড়ে বহু বছর ধরে প্রচলিত প্রবাদটি— যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত— পুরনো হয়ে গেছে। শিক্ষা এখন আর উন্নতির চাবিকাঠি নয়, উন্নতির চাবিকাঠি হলো অর্থ!

মোটা দাগে বলতে গেলে, সচরাচর করারোপ করা হয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর, যারা পণ্য উৎপাদন করে এবং তা বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করে। তবে সব ক্ষেত্রে জনস্বার্থে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করমুক্ত থাকে, সে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সংবিধানেও নির্দেশনা রয়েছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত আইনে স্পষ্ট বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে অলাভজনক। তাহলে প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে কর আরোপ কতটা যৌক্তিক?

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি এ আইন ভঙ্গ করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, অর্থাৎ উদ্যোক্তারা যদি শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করেন, তো সেটা দেখার এবং নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অর্থাৎ সরকারের। সরকারের বরং সেদিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। হতে পারে কিছু অসাধু উদ্যোক্তা শিক্ষা নয়, বরং সার্টিফিকেট বাণিজ্য তথা ব্যবসা করার স্বার্থেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এজন্য নিশ্চয় সত্যিকারের শিক্ষা উদ্যোক্তারা দায়ী নন। এ দায়ভারও অন্য কারো নয়, সরকারের ওপরই বর্তায়। প্রশ্ন হলো, এসব উদ্যোক্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণ কী? এখন অসাধু উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে যদি এই করারোপ করা হয়ে থাকে, তবে নিয়ন্ত্রণ নয় বরং তাদেরকেই প্রতিষ্ঠা করা হলো। তাদের হীন চাওয়াকে আইন দ্বারা স্বীকৃতি দেয়া হলো। তারা যেটা চাইছিল; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা— এখন অন্যান্য পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মতো কর আরোপ করে তাদের ব্যবসায়িক স্বীকৃতি দেয়া হলো। এটা কোনো শুভ বুদ্ধির লক্ষণ নয়।

শুনেছি সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, এই ভ্যাট নাকি শিক্ষার্থীদের নয়; দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু সত্যিকার বাস্তবতা কি তা-ই? কর সবসময় গিয়ে বর্তায় ভোক্তা পর্যায়ে— এ যুক্তি থেকে এরই মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নোটিস দিয়ে পরবর্তী সেমিস্টার থেকে আগের নিয়মিত টিউশন ফির সঙ্গে ভ্যাট বাবদ অতিরিক্ত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বেশি টিউশন ফি দিতে হবে বলে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিয়েছে। তাহলে এই ভ্যাট কার ওপর গিয়ে পড়ল— বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, নাকি সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দিতে মরিয়া জিম্মি অসহায় অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর?

ছয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়ে ১২ শিক্ষাবর্ষ পার করার পর শিক্ষার্থীর বয়স হয় ১৮ বছর। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, এ বয়সে আইনত কোনো শিক্ষার্থী আর শিশু থাকে না, হয়ে যায় পূর্ণবয়স্ক মানুষ। মোদ্দাকথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বয়সে একজন শিক্ষার্থী পূর্ণবয়স্ক স্বাধীন মানুষ থাকে। তখন শিক্ষার্থী নিজেই হয়ে পড়ে নিজের অভিভাবক। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় নিজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে; কেউ টিউশনি করে, কেউ পার্ট-টাইম চাকরি করে, কেউ এর চেয়েও কঠিন কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগায়। এ অবস্থায় কোন বিবেচনায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপর কর আরোপ করা যায়? যদি তার বার্ষিক রোজগারের হিসাবও করা হয়, তবে বরং সরকারের পক্ষ থেকে ভাতা দেয়া নৈতিক হয়ে পড়ে।

জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা মাত্র ৩২টি, যার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১২টি, চট্টগ্রামে ৬টি, রাজশাহীতে ৪টি, খুলনায় ৪টি, সিলেটে ২টি, বরিশালে ২টি এবং রংপুর বিভাগে ২টি অবস্থিত। গত বছরের হিসাবমতে, এই ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেটসহ মোট আসন সংখ্যা ৫৯ হাজার ২০০, যার প্রায় ৮ হাজার ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্সের জন্য। এছাড়া দেশে আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য মোট আসন সংখ্যা ৫৪ হাজারের কিছু বেশি।

এর বিপরীতে এবার শুধু জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪২ হাজার ৮৯৪ জন, যা ২০১৪ সালে ছিল ৭০ হাজার। শুধু এ বছর জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলে আসন খালি থাকে মাত্র ১১ হাজার। এদিকে গত বছর জিপিএ ৫ পাওয়া ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর সবাই ভর্তি হতে পারেনি। বাকি আসনগুলো গত বছরের বাদ পড়া ১৬ হাজার জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের থেকে পূরণ করলে অন্যান্য শিক্ষার্থী যাবে কোথায়? কেননা এ বছর ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭২ জন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৯০।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, গত বছরের হিসাবমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারা দেশে স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজারের মতো। এখন হিসাব মেলাতে গিয়ে রীতিমতো লজ্জা পেতে হচ্ছে; প্রায় সাড়ে ৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য সরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আসন সংখ্যা মাত্র ৩ লাখ। তাহলে বাকি সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? তারা সবাই কি ডিগ্রি পড়বে? এখান থেকেই অনুমেয় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কতটা দরকারি।

পাস করা সব শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা সরকার নিশ্চিত করলে নিশ্চয় কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি খরচ করে পড়তে চাইবে না। যারা পড়তে চাইবে তাদের সংখ্যা খুব কম। কোনো মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থী শখ করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় না। দুরারোগ্য ব্যাধি হলে অজপাড়াগাঁয়ের কৃষকও যেমন জীবনের শেষ সম্বল বিক্রি করে শুধু জীবনের প্রয়োজনে বিদেশে ভালো চিকিৎসার জন্য যায়, তেমনি সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করার আশায় সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় অভিভাবক শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে। আর সরকার দুর্নীতিবাজ, সরকারি টাকা লুটপাটকারী, ঋণখেলাপিদের না ধরে এসব অসহায় অভিভাবকের কাঁধে সন্তানের শিক্ষার কর আরোপ করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আরেকটি কথা জোর দিয়ে বলা যায়, রাজনৈতিক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো মেধাবীকে প্রাণ দিতে হয়নি। এর বিপরীতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র সবারই জানা।

আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বিষয়। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরের মার্চে বিশ্বখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বস বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রশংসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মোট নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ই বেসরকারি। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে করা অনুরূপ তালিকায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এটিও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্বব্যাপী যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শ্রেষ্ঠ হতে পারে, তবে আমাদের দেশে কেন উল্টো চিত্র? নতুন কিছুকে সবসময় তাচ্ছিল্যভরে ছোট করে দেখা আমাদের ঐতিহ্যগত অভ্যাস। আমাদের জামদানি পরা ওরিয়েন্টাল মরালিটি খুব সহজে নতুন কিছু গ্রহণ করতে জানে না। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও দেশে এখনো সম্মানের আসন নিতে পারেনি।

সম্প্রতি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক খন্দকার দিদার-উস-সালাম, শিক্ষার্থী আরফি মাহমুদ ও ফরহাদ হোসেনের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। তিন সপ্তাহের মধ্যে অর্থ সচিব, শিক্ষা সচিব, এনবিআর সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আমরা আশা করছি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ বৈষম্য অনুধাবন করে এই কর প্রত্যাহার করে উচ্চশিক্ষাকে আরো গতিশীল করবেন। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সরকারি, বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ তৈরি করে দেবেন। স্বপ্নের দেশ গড়তে দেশের সব নাগরিক বৈষম্যহীনভাবে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাবে।

কৃতজ্ঞতা: বণিক বার্তা

Sharing is caring!

Leave a Comment