নবীন উদ্ভাবকদের মেলা
- মারুফ ইসলাম
পত্রিকা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের খবর। হতাহত হয় মানুষ। এর কী কোনো সমাধান নেই? বিষয়টি খুব পীড়া দেয় আব্দুল্লাহ আল ইয়ামিন, শামসুজ্জামান মিয়া ও প্রসেনজিৎ বৈরাগীর মনে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে (সিএসই) পড়ুয়া এই তিন বন্ধু প্রায়ই এ নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনার পথ ধরেই একদিন তাদের মাথায় আসে ‘স্মার্ট হোম অটোমেশন সিস্টেম’ আইডিয়া। আইডিয়াটি শেষতক পুরস্কার এনে দেবে তাদের জীবনে, তা কি ভেবেছিলেন এই তিন বন্ধু?
‘কনফিডেন্স ছিল যে ভালো একটা প্রজেক্ট বানিয়েছি। কিন্তু সেটা যে প্রথম পুরস্কার অর্জন করবে তা অবশ্য ভাবিনি।’ বলছিলেন আব্দুল্লাহ আল ইয়ামিন। ড্যাফোডিল আইসিটি কার্নিভালে তখন উৎসবের ছোঁয়া। শত শত প্রজেক্ট নিয়ে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী সমবেত হয়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস আশুলিয়ার স্বাধীনতা সম্মেলন কেন্দ্রে। সবার দৃষ্টি এখন এই বিজয়ীদের দিকে। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আওয়াজ আর ফ্ল্যাশের আলোয় উজ্জ্বল চারপাশ। ছবি শিকারীদের সামলিয়ে কথা শুরু করেন ইয়ামিনের বন্ধু প্রসেনজিৎ–‘আমরা যদি আগে থেকেই জানতে পারি যে ছিদ্র হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার নির্গমণের পথ, তাহলে কিন্তু দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো যায়। আমাদের এই সিস্টেমটি সেই আগাম সতর্কতাই দেবে।’
বাকিটা ব্যাখা করেন এই প্রজেক্টের আরেক সদস্য শামসুজ্জামান–‘আপনার বাসার গ্যাস নির্গমণের পথে ছিদ্র হলে বা যেকোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাদের এই অ্যাপটি সঙ্গে সঙ্গে আপনার মেসেঞ্জারে একটি নোটিফিকেশন পাঠিয়ে দেবে। শুধু তাই নয়, এটি গ্যাস সাপ্লাইয়ের মূল লাইন থেকে সংযোগ বিচ্ছন্ন করে দেবে।’
শামসুজ্জামান যখন বলছিলেন এসব তখন পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন এক শিক্ষক। তিনি বললেন, বাহ! খুবই চমৎকার আইডিয়া তো। আমার বাসার জন্য একটি দরকার। কত খরচ পড়বে এটা কিনতে?
শামসুজ্জামান হাসি মুখে বললেন, ‘মাত্র দেড় হাজর টাকা স্যার।’ দেখতে দেখতে আরও অনেকেই অগ্রিম বুক দিলেন সিস্টেমটি কেনার।
এছাড়া আরও কার্যকারিতা রয়েছে অ্যাপটির। এটির মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বাল্ব ও ফ্যানসহ চারটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যেমন এই অ্যাপ চালু করে ‘লাইট অফ’ লিখলে বা মুখে উচ্চারণ করলে সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক বাতি নিভে যাবে। একইভাবে ফ্যানের স্পিড বাড়ানো ও কমানো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আপাতত চারটি ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও অচিরেই ১৬টি ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে জানান অ্যাপটির উদ্ভাবকরা।
এমন সময়পোযোগী ও দরকারী একটি প্রজেক্ট যে পুরস্কার জিতবে তা তো বলাই বাহুল্য। গত ২৬ অক্টোবর ড্যাফোডিল আইসিটি কার্নিভালে এ রকম আরও দশটি প্রজেক্ট জিতে নিয়ে নিয়েছে পুরস্কার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কামিশন বাংলাদেশের সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের হাতে মোট ২০ লক্ষ টাকার পুরস্কার তুলে দেন। এ সময় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান, উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলামসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
সেরা দশ প্রকল্প
১. স্মার্ট হোম অটোমেশন সিস্টেম (সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী)
২. স্কুল ৩৬০ (সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী)
৩. রিমোট ডক্টর (সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী)
৪. সয়েল মনিটরিং সিস্টেম (সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী)
৫. ডিআইইউ ক্যাম্পাস গাইড (সিএসই বিভাগ-স্থায়ী ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী)
৬. অটোক কনট্রোলিং পোলট্রি (বিএসডিআই ও ডিপিআইয়ের শিক্ষার্থী)
৭. অকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএস বিভাগের শিক্ষার্থী)
৮. বেকারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএস বিভাগের শিক্ষার্থী)
৯. হ্যাপি হাব (বিএসডিআই ও দিপ্তির শিক্ষার্থী)
১০. স্মার্ট ফার্ম থ্রো আইওটি (সিএসই বিভাগ-স্থায়ী ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী)
মুগ্ধতা ছড়িয়েছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের প্রকল্প
ড্যাফোডিল আইসিটি কার্নিভালে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে এক ঝাঁক ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের প্রকল্প। তারা এসেছিল ড্যাফোডিল ইন্টারনাশনাল স্কুল ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ থেকে। যেমন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সোহা, নাবিলা ও বিথি বনিকের তৈরি করা ‘প্রোগ্রামিং লার্নিং রোবট’ তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিচারকদের। ওই স্কুলেরই আরেকটি দল অদ্রি মুনতাহিন, আরাফ আজমাইন ও সানজানা বানু এনেছিল ‘জিএসএম বেসড শিপ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’। এটিও বিস্মিত করেছে সবাইকে। এত ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের মাথায় এত জটিল ভাবনা এলো কী করে! সানজানা বলছিল, ‘এই সিস্টেম ব্যবহার করলে লঞ্চ দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।’ ড্যাফোডিল কলেজ থেকে এসেছিলেন আবু বচ্চন এহসান, খাজা কাশফি ও অর্ণব রায়। তাদের প্রকল্পের নাম ‘এগ্রো সলিউশন রোবট’। এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার।
দ্বিতীয়বারের আয়োজন
দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো ড্যাফোডিল আইসিটি কার্নিভাল। এ যেন নবীন উদ্ভাবকদের মিলনমেলা। এবারের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি (এমসিটি) ও কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগসহ ড্যাফোডিল এডুকেশন নেটওয়ার্কের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী প্রায় শতাধিক প্রকল্প প্রদর্শন করেছে। এর আগে গত বছরও বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দেশের সবচেয়ে বড় এ আয়োজন।
সারা বছর অপেক্ষা করি
এ শুধু গতানুগতিক এক প্রজেক্ট প্রদর্শনী প্রতিযোগিতা নয়, এ যেন নবীন উদ্ভাবকদের এক মিলনমেলা। কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী শাহারুফ হোসেন এসেছেন ‘অটো পার্টস ই-শপ’ প্রজেক্ট নিয়ে। তিনি বলেন, ‘সারা বছর অপেক্ষা করি আইসিটি কার্নিভালের জন্য। এখানে যেমন নিজের প্রজেক্ট উপস্থাপন করা যায়, তেমনি অন্যদের প্রজেক্টও দেখার সুযোগ দেয়। অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়। এক কথায় আইডিয়া জেনারেট করা যায়।’ শুধু কী তাই? ‘বিভিন্ন বিভাগ থেকে যারা প্রজেক্ট নিয়ে এসেছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই এক ধরনের বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে।’ বলছিলেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী সাদিকা সুলতানা।
এভাবে স্টল ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় কাশফিয়া তাবাসসুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি এবার কোনো প্রজেক্ট নিয়ে আসিনি। অন্যদের প্রজেক্ট দেখছিলাম আর অনুপ্রাণিত হচ্ছিলাম। আগামী বছর অবশ্যই প্রজেক্ট নিয়ে আসব।
প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হবে
এ আয়োজন প্রতি বছর নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান। তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদেরকেও এ কার্নিভালে আমন্ত্রণ জানানো হবে। শুধু তাই নয়, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষার্থীদের চাকরি নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যতে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট ফেয়ারের আয়োজন করবে।
ড. মো. সবুর খান আরও বলেন, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় যদি এসব আইডিয়া সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও এসব জ্ঞান বিনিময় করতে পারবে। এসময় তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, একজন শিক্ষার্থী যেন প্রথম সেমিস্টার থেকেই একটি প্রজেক্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারে এবং গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই ওই প্রজেক্টের মাধ্যমে সে যেন স্বাবলম্বী হতে পারে, সেই ব্যবস্থা শিক্ষকদেরই করতে হবে।
পুরস্কারের সঙ্গে বইও থাকুক
মুগ্ধতা প্রকাশ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী মেধাকে বিকশিত করতে সাহায্য করবে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্য পুস্তকের বাইরে এসে নিজের মেধাকে যাচাই করার সুযোগ পাবে। তাই এ ধরনের প্রতিযোগিতা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা উচিত।
এ সময় তিনি নিজের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমাদের সময়ে এ রকম প্রজেক্ট বানিয়ে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ খুব একটা ছিল না। আমাদের জ্ঞান তাই পাঠ্য পুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই দিক থেকে তোমরা অনেক ভাগ্যবান। তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তোমাদেরকে প্রজেক্ট উপস্থাপনের সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এজন্য বড় অঙ্কের অর্থ পুরস্কারও দিচ্ছে।
সবশেষে তিনি বলেন, পুরস্কারের সঙ্গে বইও রাখা উচিত। কারণ প্রযুক্তির এই আগ্রাসী যুগে ছেলেমেয়েরা বই পড়তে ভুলে যাচ্ছে। তাদেরকে বইমুখী করা উচিত। কারণ বই না পড়লে মননশীলতা তৈরি হয় না। বই-ই জ্ঞানের জগতে প্রবেশের প্রথম ধাপ। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অন্যান্য পুরস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পুরস্কার দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।