ভুটানে সাত দিন
- জুই রায়
গত ২১-২৮ মে ভুটান শিক্ষাসফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল অপার আনন্দে ভরপুর। তার আগে ২২ এপ্রিল ছিল আমার জীবনে এক বিশেষ দিন, কারণ ওই দিন ছিল আমাদের র্যাগ ডে। আর ওই দিনই আমি ভুটান সফরের জন্য ডাক পাই। শিক্ষাসফরটির আয়োজক ছিল গার্লস ইন স্কাউটিং, বাংলাদেশ। এই শিক্ষাসফরের জন্য বাংলাদেশ স্কাউট সারা বাংলাদেশের স্কাউট গ্রæপ থেকে ৪জন নারী স্কাউট, রোভার স্কাউট থেকে ৪জন নারী রোভার এবং ৩জন অীভজ্ঞ নেতা নির্বাচন করেছিল। ভুটান সফরের আগে আমরা সবাই যখন কাকরাইল ন্যাশনাল হেডকোয়ার্টারে মিলিত হই তখন প্রত্যেকের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল বিস্ময়। কারণ, আমরা কেউ কাউকে চিনি না! কিন্তু সফর শেষে আমরা এখন পরস্পরের কতই না আপন! বিদায়ের মুহূর্তে সবার চোখ ভিজে উঠেছিল অশ্রুতে।
ঢাকা থেকে ভুটানের থিম্পুতে পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছিল ২৪ ঘণ্টারও বেশি। আমরা বুড়িমারি ও জয়গং সীমান্ত হয়ে ভুটান গিয়েছিলাম। যখন আমরা ভুটানে পা রাখি তখন পাহাড়, আকাশ আর মেঘ যেন ঝুঁকে পড়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছিল। প্রকৃতিও এত সুন্দর হয়! যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা।
আমাদের বিস্ময়ভাব কেটে যায় একটু পর। উঁচু-নিচু, এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় চলতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি কেউ কেউ। এ অবস্থায় রাত ৯টায় আমরা থিম্পুতে পৌঁছাই আর শহরের মনমুগ্ধকর আলোকসজ্জা দেখে মুহূর্তেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বিশেষ করে তাশিচোজং শহরের আলোকসজ্জা ভোলার মতো নয়।
এরপর থিম্পুর হোটেল শের-এনইয়াতে আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান থরমেড স্কাউট অ্যাসেসিয়েশনের প্রধান কমিশনার নামগুয়েল দর্জি।
আমাদের এই শিক্ষাসফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত বিশ্ব নির্মাণ এবং স্কাউট কার্যক্রমে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংস্কৃতি বিনিময় করা। সফরকালে আমরা ভুটানের জিগমে নামগিয়েল নি
মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ড্রুয়েল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং হংথসু প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করি। এসব স্কুলের স্কাউটদের সঙ্গে আমরা মত বিনিময় করি, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করি।
পাহাড়ঘেরা স্কুলগুলো অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন এবং প্রকৃতির ছায়ায় ঘেরা। প্রতিটি স্কুলে রয়েছে বড় বড় খেলার মাঠ আর হোস্টেল। ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা তাদের আঁকা চিত্রকর্ম ও সৃজনশীল কাজ দিয়ে সাজিয়েছে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ। তারা নিজেরাই ক্যাম্পাস পরিস্কার করে, গাছের গোড়ায় পানি দেয় এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ টিফিন ব্যাগ নির্দিষ্ট স্থানে রাখে।
একটা ব্যাপার আমার নজর কাড়ল, স্কুলের এক কোণায় স্কুলের অধ্যক্ষ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে পড়াচ্ছেন। এই শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তাই তাদের আলাদাভাবে যত্ন নেয়া হচ্ছে।
আমরা ভুটানের একটিমাত্র বিমানবন্দন পরিদর্শন করেছি। সেই পারো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের সৌন্দর্য যেন এখনো চোখে লেগে আছে। এছাড়া থিম্পুর বোটানিক্যাল গার্ডেন, মহাবুদ্ধ আশ্রম, বিশ্বের সবচেয়ে বড় রূপালী বুদ্ধ মূর্তি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ডকুলা পাস, তামেহু লাখাং, কিং প্যালেস ইত্যাদি পরিদর্শন করি।
এই শিক্ষাসফরের প্রোগ্রাম ও পরিকল্পনা নির্বাহী কিনলে ওয়াংহুক সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনিই ছিলেন আমাদের ভ্রমণ গাইড। তাঁর বন্ধুত্ব, সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ ও আতিথেয়তা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো।
আমাদেরকে একদিন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের থিম্পুর বাসায় নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেদিন আমরা মজার মজার সব খাবার খেয়েছিলাম।
সবমিলিয়ে, ভুটান সফরটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, এ কথা বলাই যায়। ভুটানের মানুষরা অসম্ভব বন্ধুবৎসল এবং অতিথিপরায়ন। দেশটা অসম্ভব রকমের পরিষ্কার। কোথাও কোনো ময়লা আবর্জনা পড়ে নেই। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, কোনো শব্দ দূষণ নেই, বায়ু দূষণ নেই, পরিবেশ দূষণ নেই। এত সুন্দর আবহাওয়া যে নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে যায় ‘এক্সিলেন্ট!’।
বাংলাদেশে ফেরার পথে আমরা দার্জিলিং ও শিলং দর্শন করতে ভুল করিনি। দাজিংলিং সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। এটি বিশ্বস্বীকৃত এক নান্দনিক জায়গা। এসময় আমরা টাইগার হিল ও বাতাসী পয়েন্টও পরিদর্শন করি।
আমার স্কাউট জীবনে নিঃসন্দেহে সবচয়ে মজার, আনন্দদায়ক ও স্মৃতিময় এক অধ্যায় থাকবে এই ভুটারসফর।