উজ্জ্বল জমকালো এক সমাবর্তন
- মারুফ ইসলাম
১৭টি বিভাগ, ১৭জন স্বর্ণপদক জয়ী, সহস্রাধিক অভিভাবক আর ৫৬৩১জন গ্রাজুয়েট। এই নিয়ে শেষ হলো উজ্জ্বল জমকালো এক সমাবর্তন। বলা হচ্ছে, এটিই বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন অনুষ্ঠান। আয়োজনটি করেছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তাদের ৮ম সমাবর্তনকে ঘিরে। ১৩ মার্চ সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস আশুলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এ বিপুল সমারোহের আনন্দযজ্ঞ।
দিনটি ছিল উজ্জল রোদের। মাথার ওপর আগুন-গরম সূর্য। সে সবকে থোরাই কেয়ার করে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিলেন নবীন গ্রাজুয়েটরা। ‘এই এই… ক্যাপটা উড়িয়ে দে… উড়িয়ে দে।’ ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে বন্ধুদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন কাজী আনিস। বন্ধুরা শুধু ক্যাপ উড়িয়েই ক্ষান্ত হলেন না, নিজেরাও শূন্যে লাফিয়ে উঠলেন খানিকটা। আনিস একে পর এক সাটার চাপলেন–ক্লিক…ক্লিক।
‘আজ খুব আনন্দের দিন, তাই না?’ জিজ্ঞেস করি আনিসকে। তিনি একগাল হেসে বলেন, ‘বিয়ে করার সুযোগ জীবনে দু-তিরবারও আসতে পারে, কিন্তু সমাবর্তন জীবনে একবারই আসে, ভাই! তাই আনন্দ করছি।’
ওদিকে অডিটোরিয়ামের পাশে ‘বনমায়া’র গাছের ছায়ায় বসে থাকা আনিকা, বুশরা, কানিজ ও মেঘলাকে খানিকটা বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। ‘ব্যাপার কী?’ কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বুশরা বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসটা এত সুন্দর, নয়নাভিরাম। এত সবুজেঘেরা প্রাকৃতিক ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হবে। শিগগিরই ঢুকে পড়ব কর্মজীবনে। চাইলেও আর যখন তখন ক্যাম্পাসে আসতে পারব না। মনটা খারাপ লাগছে।’
তাই বলে কী ছবি তোলা বন্ধ থাকবে? মোটেও না। বুশরাদের বন্ধু শিপলু, বিকাশ, অর্ক, মিনহাজ ও মাহাদী হৈ হৈ করতে করতে ছুটে এলেন বুশরা-আনিকাদের কাছে। ‘তোরা এখানে বসে রাণীক্ষেত রোগেধরা মুরগির মতো ঝিমাচ্ছিস? আর সারা ক্যাম্পাস খুঁজে মরছি তোদের! আয়, আয় স্মৃতি ধরে রাখি। এরপর তো এভাবে সবাই একসাথে হওয়া হবে না রে।’
কথা ঠিক। বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের সর্বশেষ স্মৃতি ধরে রাখা উচিত। দোলনায় গিয়ে বসে পড়লেন মেয়ে বন্ধুরা। আর তাদের পেছনে দাঁড়ালেন ছেলেরা। ক্যামেরায় ক্লিক করলেন বিকাশ। হয়ে গেলে গ্রুপ ফটো। মাহাদী বললেন, ‘একটা ভিডিও হয়ে যাক। ফেসবুকে দিতে হবে না?’
বিকাশ ভিডিওর জন্য আবার ক্যামেরায় চোখ রাখেন।
এইসব ফটোগ্রাফি আর ভিডিওগ্রাফির ফাঁকে ফাঁকে সিরিয়াস কথাবার্তাও শোনা গেল গ্রাজুয়েটদের মুখে। ‘স্টুডেন্ট লাইফ তো শেষ হলো, এবার ক্যারিয়ার লাইফ।’ বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের পাশে বসে বলছিলেন ইশরাক। তার কথার সূত্র ধরে তারেক বলছিলেন, ‘দেশে চাকরির বাজার তো দেখতেই পাচ্ছিস। লক্ষ লক্ষ বেকার। আমি ভাই উদ্যোক্তা হতে চাই। থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় থেকেই একটা অনলাইন শপ চালাচ্ছিলাম। ওটাতেই মনোযোগী হবো এবার।’ তারেকের পিঠ চাপড়ে দিয়ে ইকবাল বললেন, ‘ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বন্ধু। একদিন তোর ই-কমার্স সাইট আলিবাবা কিংবা অ্যামাজনের মতো বড় হবে। হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান করবি তুই। ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে উঠছে।’
ক্যারিয়ারের গল্প করতে করতে কানে ভেসে এলো মাইকের শব্দ—মিলনায়তনে প্রবেশ করছেন সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথিরা। বন্ধুরা ছুট লাগালেন স্বাধীনতা মিলনায়তনের দিকে।
সমাবর্তনের এই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তোমরা সেই সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হলে। তোমদের হাত ধরেই দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তোমরা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে জ্ঞান, মেধা ও দক্ষতা অর্জন করেছ তা দেশের কল্যাণে ব্যয় করবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১কে সামনে রেখে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইমিতধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বংয়সম্পূর্ণতা, নারীর ক্ষমতায়নসহ নানা ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশকে এশিয়ার সবচেয়ে বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই অগ্রযাত্রার পথে নবীন গ্রাজুয়েটদেরকে স্বীয় মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে অবদান রাখার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন থাইল্যান্ডের সিয়াম ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ড. পর্নচাই মঙ্গখোনভানিত। তিনি বলেন, আমার সামনে দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যতের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, কর্পোরেট নেতা, ফার্মাসিস্ট, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ। তোমরাই এ দেশকে বদলে দেবে। শুধু তাই নয়, আমি বিশ্বাস করি, তোমরা পরবর্তী প্রজন্মের পথ মসৃন করার জন্য মানবিক স্বপ্ন দেখবে এবং সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান ও বিভিন্ন অনুষদের ডিনগণ।
সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে সূর্য মধ্য গগণে উঠে যায়। মধ্যাহ্ন ভোজ সেরেই গ্রাজুয়েটরা আবার মেতে ওঠেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আনন্দে। সন্তানের আনন্দের সঙ্গে একাত্ম হোন অভিভাবকরাও। প্রিয় ছেলেমেয়েদের এই গাউন, হ্যাটের সঙ্গে লেগে আছে তাদেরও খানিকটা শ্রম-ঘাম। একজন অভিভাবক বলছিলেন, ‘আমরা চেয়েছি সন্তান যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় সেই চাওয়া পূরণ করেছে। বাবা মা হিসেবে আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আর এতবড় আয়োজন দেখে সত্যিই অভিভূত হয়েছি। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে, অথচ কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।’
গ্রাজুয়েটদের নাচ, গান, আনন্দ, উল্লাস আর সেলফি তোলার মহাযজ্ঞ চলে সন্ধ্যা অবধি। তারপর ফুরায় আনন্দযজ্ঞের সমাবর্তন। কিন্তু রেশ রয়ে যায় মনে।