আনন্দযজ্ঞের একদিন
- যারিন তাসনিম
সব দিনই সূর্য ওঠে, সকাল হয়, পাখি গান গায়, ফুল ফোটে, নদী বয়ে চলে তবু কোনো কোনো দিন ঠিক অন্য দিনের মতো হয় না। ২৫ মার্চ এরকমই এক স্মরণীয় দিন হয়ে এসেছিল পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জীবনে। সন্দেহ নেই, দিনটিকে অনেকেই স্মৃতির পাতায় সোনার আখরে লিখে রাখবেন।
সেদিন সকালটা শুরু হয়েছিল অনেক সকালে। দীর্ঘদিন ধরে ভোরের সূর্য ওঠা দেখা হয় না যে ফাল্গুনী, তাজকিয়া, আন্নি, অত্রি, রুমকির- সেদিন তাদেরও সৌভাগ্য হয়েছিল ডিমের কুসুমের মতো হলুদ সূর্য দেখার। তারপর সাজগোজ করে তৈরি হতে হতে সকাল আটটা। অন্য বন্ধুরা তাড়া লাগায়-‘লেট হয়ে যাচ্ছে তো!’ অতএব নাস্তা না খেয়েই দে দৌড়।
বাস আগে থেকেই তৈরি হয়ে অপেক্ষায় ছিল টিচার্স ক্লাবের সামনে। তো আর দেরি কেন, হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ো বাসের ভেতরে। সব শিক্ষার্থী ওঠামাত্র ছেড়ে দিল বাস। গন্তব্য নাটোর উত্তরা গণভবন।
এই আনন্দভ্রমণের এক কেতাবী নাম আছে-‘স্টাডি ট্যুর’, বাংলায় আমরা বলি ‘শিক্ষা সফর’। সেই সফরেই যাচ্ছেন এই শিক্ষার্থীর দল। সঙ্গে আছেন বিভাগের চেয়ারম্যান ইমরান পারভেজ ও শিক্ষক শাহানাজ পারভিন। প্রথমে তারা যাবেন উত্তরা গণভবন তারপর যাবেন বগুড়ার মহাস্থান গড় এবং সেখান থেকে আবার নাটোর রাজবাড়ি হয়ে ফিরবেন নিজেদের ক্যাম্পাস পাবনায়।
নাটোর পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়িতে বেজে গেল দুপুর দুইটা। সারাটা পথ উচ্চস্বরে গানের সঙ্গে চলেছে নাচানাচি। শিক্ষকরা ভেবেছিলেন এই দুষ্টুর দল ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়বে অচিরেই। কীসের ক্লান্তি! কীসের কী! উত্তরা গণভবনে নেমেই শিক্ষার্থীরা শুরু করেন সেলফি তোলা। কেউ কেউ অপার বিস্ময়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন ভবনটার প্রতি ইঞ্চি জায়গা।
‘এই সেই গণভবন! এককালে দিঘাপাতিয়ার মহারাজারা বাস করতেন এখানে!’ বিস্ময় ঝরে পড়ে দিলরুবার কণ্ঠে। তার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেন স্মরণ, ‘এখন অবশ্য এটি উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস। পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান গভর্মেন্ট হাউস। পরে ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর নাম রাখেন উত্তরা গণভবন।’
পুরো স্থাপনা ঘুরে ঘুরে দেখার পর শিক্ষার্থীরা আবার চেপে বসে গাড়িতে। গাড়ি ছুটে চলে মহাস্থান গড়ের দিকে। বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ গাড়ি গিয়ে থামে মহাস্থান গড়ে। শিক্ষার্থীরা হই হই করে নেমে পড়ে প্রাচীন বাংলার এ রাজধানীর বুকে। জাকিয়া বলেন, ‘কে বলবে, এটাই ছিল এক সময়ের বাংলার রাজধানী!’ পাশের বন্ধু হাবিব বলেন, ‘এটা নাকি একসময় রাজা পরশুরামের বসতবাড়ি ছিল। পরে এক ইসলাম প্রচারক দরবেশ হয়রত শাহ সুলতান বলখী পরশুরামের দূর্গ দখল করেন।’ এ কথা বলতেই আরেক বন্ধু আকাশ বলেন, ‘ওই যে ওই যে শাহ সুলতান বলখীর মাজার!’ এরপর দলবেঁধে সবাই মাজার দেখতে মনযোগ দেন। এদিকে আকাশরা যখন মাজার দেখায় ব্যস্ত তখন ওদিকে খালেদ ও তার বন্ধুরা মহাস্থানের ঐতিহাসিক খাবার ‘কটকটি’ খাওয়ায় ব্যস্ত।‘মহাস্থান এসেছি আর কটকটি খাব না, তা কি হয়!’ কটকটিতে কামড় বসাতে বসাতে বলেন ফাল্গুনী।
মহাস্থানগড় পরিদর্শন শেষে এই তরুণ পরিব্রাজক দল আবার চেপে বসে বাসে। বাস ছুটে চলে ফের নাটোর রাজবাড়ির উদ্দেশে।
রাজবাড়ির আঙ্গিনায় পা দিয়েই মুগ্ধ হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। কী অপূর্ব সুন্দর স্থাপনা! শিক্ষক শাহানাজ পারভিন বলেন, ‘রাজবাড়ির এই ঐশ্বর্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় কতটা সমৃদ্ধ ছিল বাংলা, কত রাজার পা পড়েছে এই বাংলায়।’ তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা আরো জানেন, মহারানী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়ি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে যে কটি রাজবাড়ি তাদের স্থাপত্য-শৈলী ও ইতিহাস দিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে আসছে তার মধ্যে নাটোরের রাজবাড়ি অন্যতম।
পুরো রাজবাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। নীড়ে ফেরার তাড়া অনুভব করে সবাই। অতএব আবার চেপে বসো গাড়িতে। গাড়ি গিয়ে যখন থামে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই!