ইবির ছাত্রী হলে বৈশাখী সন্ধ্যা
- শাহজাহান নবীন
বাঙালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাংলা পঞ্জিকা প্রবর্তণের সাথে সাথে বছরের প্রথম দিনকে ঘিরে শুরু হয় নানা আয়োজন আর নানান উৎসব। হালখাতা, গ্রামীণ বৈশাখী মেলা, লাঠিখেলা, ঘৌড়দৌড়, নৌকা বাইচ আরো কত কি! এসবই যেন বাঙালীর অস্তিত্বের আয়োজন। তেমনি ঐতিহ্যবাহী স্বতন্ত্র খাবার, মুড়ি-মুড়কির নাস্তা আর পিঠাপুলি বাঙালী সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব ছাড়া ভোজনবিলাসী বাঙালীর এক প্রহর কি চলে? চলে না। পহেলা বৈশাখের দিন বর্ষবরণে আগেকার যুগের মত এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে কিছু আয়োজন। মঙ্গল শোভাযাত্রা, লোকজ মেলা এখনো চোখে পড়ে। নববর্ষের এসব আয়োজন দেশের গ্রাম-গঞ্জে অহরহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাঙালী সংস্কৃতির নিদর্শন খুব কমই দেখা মেলে। বড়জোর মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পান্তা-ইলিশেই সীমাবদ্ধ থাকে ক্যাম্পাস গুলোর আয়োজন।
তবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নববর্ষের আয়োজনটা বেশ আলাদা। শহর থেকে দুরে নিবিড় পল্লীতে অবস্থিত এই ক্যাম্পাস পহেলা বৈশাখে ফিরে পায় গ্রামের প্রকৃত রূপ। ছায়া সুনিবীড় পরিবেশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি এই বিদ্যাপীঠ। এবছর পহেলা বৈশাখে বেশ সরগরম ছিল পুরো ক্যাম্পাস। তবে দিনের বেলা যে অনুষ্ঠানই হোক না কেন রাতের বেলা বেশ নির্জীব ছিল ক্যাম্পাস। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল শুধু বেগম খালেদা জিয়া হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য প্রথম নির্মিত এই হল বর্ষবরণে মেতে উঠেছিল ঠিক সূর্যাস্তের পর থেকে। চোখ ধাঁধাঁনো আতশবাঁজি ফুটানোর মধ্যদিয়ে শুরু হয় বৈশাখী সন্ধ্যা সাজানোর আয়োজন।
হলের অভ্যর্থনা কক্ষে দু সারি টেবিল জলরঙা কাগজে মোড়ানো। স্বচ্ছ কাগেজর নিচে লাল-হলুদ ফুলের পাপড়ী ছড়ানো। একে একে অতিথিরা আসছেন। বসছেন সাদা কাপড়ে মোড়ানো প্লাস্টিকের চেয়ারে। যদিও চেয়ার প্লাস্টিকের কিনা বুঝা যায় নি। বাঙালীর প্রিয় খাবার চিড়া-দধি, মুড়কি, খই, পিঠা, লাড্ডু, নারকেলের নাড়–, বাতাসা, কদমা, বেলের সরবত আরো কত কিছু দিয়ে টেবিলের উপর মাটির থালা সাজানো।
নাস্তা পর্ব শেষে শুরু হয় হলের বিদায়ী ছাত্রীদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। হলের নয়া উপাধ্যক্ষ ড. মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বিদায় বেলায় রম্যরসাত্মক বক্তব্য রাখেন বিদায়ী উপাধ্যক্ষ ড. সাইদুর রহমান।
আবাসিক ছাত্রী শাহেদা আক্তার আশার সঞ্চালনায় প্রথম পর্বে উপস্থিত ছিলেন হলের আবাসিক শিক্ষক জসিম উদ্দিন, আরমিন খাতুন, সোনিয়া শারমিন। রাত সাড়ে নয়টার পর অভ্যর্থনা কক্ষে আবারো খাবারের আয়োজন। শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, টমেটোর চাটনি, বেগুনের ঝাঁল চাটনি, লাউ পাতা-চিংড়ি ভর্তা, কমুড়োর বড়ি ভর্তা, কলার খোসা ভর্তা, বেগুন ভর্তা সেই সাথে সরষে ইলিশ সহ হরেক পদের উপস্থিতিতে থালায় যেন ভাত খুজে পাওয়া দায়।
“ভোজন প্রিয় বাঙালীর রসনায় তৃপ্তির রস দিতে এসব খাবারের কোন জুড়ি নেই। অনেক দিন পর সবগুলো পদ একসাথে খেয়ে খাঁটি বাঙালীর স্বাদ পেলাম।” এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন ড. সাইদুর রহমান।
“আমার হলের ছাত্রীরা সব কাজে পটু। সারাদিন তারা এসব নিজ হাতে রান্নাবান্না করেছে। তবুও তাদের চোখে মুখে কোন ক্লান্তি নেই। অতিথি পরায়ণতায় বাঙালী মা বোনেদের কোন তুলনা হয়না। আমার হলের ছাত্রীরা সব্যসাচী। তারা সব পারে। খেলাধুলা, নাচ-গান, কবিতা, বিতর্কসহ সব ক্ষেত্রেই তাদের দখল রয়েছে।” এভাবে নিজের হলের ছাত্রীদের প্রশংসা করলেন নয়া প্রাধ্যক্ষ ড. মোস্তফা কামাল। তিনি আরো জানান, হলের আবাসিক ছাত্রী রুবাইয়াত ইয়াসমিন আঁখি, উম্মে তাসলিমা আক্তার ঋতু, নুসরাত, সীমা, এমি, জুঁই সহ কয়েকজন মিলে সারাদিন ধরে খাবার তৈরী করেছে। সব খাবার ছাত্রীদের নিজেদের তৈরী করা।
অন্যদিকে হলের সাংস্কৃতিক মঞ্চে একের পর এক নৃত্য, আবৃত্তি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন আবাসিক ছাত্রী জেরিন। এছাড়া স্নিগ্ধা, নন্দিতা, শিউলীদের পারফরমেন্স অনুষ্ঠানকে ষোলকলায় পূর্ণতা দেয়। আর এভাবেই মধ্যরাত অবধি বর্ষবরণের রঙিন নেশায় মেতে থাকে প্রাণবন্ত খালেদা জিয়া হল। কংক্রিটের তৈরী হলেও আবাসিক এই হলটি তার বুকে এভাবেই আগলে রেখে চলেছে শত শত ছাত্রীকে। ‘ঠিক যেন মায়ের মমতায়’। আর এমনি আয়োজনের মাধ্যমে বৈশাখী সন্ধ্যার আয়োজন সাঙ্গ হয় তিমির রাতের আঁধো চাঁদ মাথায় নিয়ে।