দূর থেকেই পড়াশোনা
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
মাদুর পেতে সারি সারি বসে আছে একদল কচিকাঁচা। পরনে সবার একই পোশাক—স্কুল ইউনিফর্ম। স্বভাবসুলভ উচ্ছলতা ছেড়ে অধীর আগ্রহে তাদের অপেক্ষা, নতুন কিছু শিখবে আজ। বই-খাতা, কলম-পেনসিল নিয়ে সবাই প্রস্তুত, অপেক্ষা শুধু তাদের ‘টিচার’-এর। শিক্ষিক এলেন। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। শুরু হলো ক্লাস, যেমনটা হয়ে থাকে। শিক্ষক তাদের সামনে তবে এই শ্রেণিকক্ষে নয়।
যে শ্রেণিকক্ষের কথা বলছি সেটাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দূরত্ব কয়েক শ মাইলের, কয়েক হাজার হলেও অবশ্য ক্ষতি নেই। প্রযুক্তির কাজই তো দূর-দূরান্তের মানুষকে এক সুতোয় বাঁধা। জাগো ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানীর রায়েরবাজারে চালু হয়েছে অনলাইন স্কুল। শিক্ষক ঢাকায় বসে পাঠদান করেন, শিক্ষার্থীরা বসে সেই পাঠ নেয় বান্দরবান, টেকনাফ কিংবা হবিগঞ্জ থেকে। অনলাইনে স্কুলে ব্যবহার করা হচ্ছে টেলি ও ভিডিও সম্মেলন প্রযুক্তি। গ্রামীণফোনের পৃষ্ঠপোষকতায় জাগো ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে অগ্নি সিস্টেমস।
৬ জুলাই বিকেলে রাজধানীর রায়েরবাজারে স্কুলটিতে গিয়ে এই শিক্ষা কার্যক্রমের বিস্তারিত জানা যায়। ‘ওসলো এডুকেশন সামিট’-এ ইন্টারনেট কীভাবে শিক্ষা বিস্তারে কাজে আসতে পারে তা তুলে ধরার জন্য বিশেষভাবে সেদিন অনলাইন স্কুলের আসরটি বসেছিল। সেদিন রাজশাহীতে কেজি-টু শ্রেণির ক্লাস চলছিল। শিক্ষক শাইলা নাজনীন। শব্দরোধী ঘরে ওয়েবক্যামযুক্ত মনিটরের সামনে বসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন জ্ঞানের আলো। মনিটরে ভেসে উঠছে শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম। মাথা দুলিয়ে সমস্বরে শিক্ষিকার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সবাই। শাইলা নাজনীন বললেন, ‘সবাই পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। সাড়াও ভালো। তবে সশরীরে উপস্থিত থেকে পাঠদানে যে সুবিধাটা, মাঝেমধ্যে এই অভাববোধটা করি।’
অপর প্রান্তে রাজশাহীতে শ্রেণিকক্ষে প্রায় ৩৫ জন শিক্ষার্থী মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শিক্ষকের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। তাদের সামনে বড় পর্দায় শিক্ষক কথা বলছেন সরাসরি। কখনো শ্রেণিকক্ষের সবাইকে শিক্ষা দিচ্ছে, নির্দিষ্ট কাউকে প্রশ্ন করলে সে দাঁড়িয়ে উত্তর দিচ্ছে। তবে প্রতিটা শ্রেণিকক্ষে একজন সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকে। সে সাধারণত শ্রেণিশিক্ষকের দেওয়া পাঠ বুঝে নিতে সবাইকে সাহায্য করে, একই সঙ্গে এতগুলো শিশুকে নিয়ন্ত্রণের কাজটাও তারই। এ প্রান্ত থেকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম কেমন আছ, সমস্বরে সবাই জানাল ভালো আছে। আরও বলল পড়াশোনা চলছে ভালোই। কথা হয় আমেনা খাতুন নামের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। সে জানায়, পড়াশোনা করতে তার খুব ভালো লাগে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত তার পছন্দের বিষয়।
২০১১ সালের আগস্টে ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে জাগোর এই অনলাইন স্কুলের যাত্রা। গাজীপুরে শুরু হয় প্রথম ক্লাস। দেশের সব প্রান্তে ভালো শিক্ষকের অভাববোধ থেকেই এই ধারণার শুরু বলে জানালেন জাগো ফাউন্ডেশনের পরিচালক করভী রাকশান্দ। বললেন, ‘সবার মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে দিলে দারিদ্র্য দূরী করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সারা দেশে অনলাইন স্কুল ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা আমাদের।’ বর্তমানে গাজীপুর, গাইবান্ধা, বান্দরবান, হবিগঞ্জ, দিনাজপুর, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, টেকনাফ, রংপুর এবং মাদারীপুরে অনলাইন স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই যেন এই শিক্ষা পায় সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখছে জাগো।
অনলাইন এই স্কুলে মূলত সরকারের পাঠক্রমের ইংরেজি সংস্করণ পড়ানো হয়। তবে শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে এর সঙ্গে আরও কিছু বই যোগ করা হয়েছে। জাগো ফাউন্ডেশনের অন্যান্য স্কুলের তুলনায় অনলাইনে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করছে বলে জানান করভী রাকশান্দ। এর কারণটাও বললেন, ‘নতুন এই মাধ্যমে সবার মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। মনে করুন, আগ্নেয়গিরি বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি একটি ভিডিওতে আগ্নেয়গিরির ভিডিও দেখালে শিক্ষাটা আরও বেশি কার্যকর হয়।’
অনলাইন স্কুল চালাতে সাধারণত ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার, ওয়েবক্যাম, বড় পর্দার টিভি, স্কেচ বোর্ড এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সমন্বয়ের জন্য সফটওয়্যার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সিসকোর ওয়েবেক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্স করা হয়। রায়েরবাজারের স্কুলের ১০টি স্টুডিও থেকে প্রতিদিন ১৯টি ক্লাস নেওয়া হয়।