শিক্ষার্থীদের নিয়ে পানি গবেষণা
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
এক দশক ধরে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পানি গবেষণা করছেন হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাহেদুল ইসলাম। তাঁদের গবেষণা নিয়ে লিখেছেন ও ছবি তুলেছেন শাহীন আলম
গবেষণাটির শুরু হয়েছিল এক দশক আগে। তখন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল—দেশের ৬১টি জেলা আর্সেনিকে আক্রান্ত। এই খবরে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন একজন মানুষ। নাম তাঁর ড. জাহেদুল ইসলাম। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পানির গুণগত মান নিয়ে পিএইচডি করেছেন। খবরটি দেখে তিনি ভাবলেন, গবেষণার মাধ্যমে বের করা দরকার, আসলেই এত বেশি এলাকায় আর্সেনিক আছে কি না। যদি থেকে থাকে, তাহলে সেই এলাকার মানুষের করণীয় কী সে সম্পর্কে জানানোই তাঁর লক্ষ্য ছিল। কারণ প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে হাত-পায়ে ঘা, নখ কালো হয়ে যাওয়া, বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
তার পর থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তিনি আর্সেনিক ও পানি গবেষণায় নেমে গেলেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সবাই হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগে পড়েন। এই বিভাগের এমএসসির ছাত্রছাত্রীদের একটি করে থিসিস করতে হয়। যার যে এলাকায় বাড়ি, তাদের সেখানে গবেষণা করতে পাঠিয়ে দেন শিক্ষক। ফলে তেমন কোনো খরচ হয় না। এভাবেই দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও বগুড়ায় ১১ বছরে মাটির নিচের পানির গুণগত মান নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা করেছেন। তারা সেসব এলাকার ডিপ টিউবওয়েল, শ্যালোমেশিন ও হ্যান্ড টিউবওয়েলের পানির নমুনা নিয়ে এসেছেন। পরে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন ল্যাবরেটরি, দিনাজপুরের মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকার মৃত্তিকাসম্পদ বিভাগের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। সেসব ফলাফলের ভিত্তিতে জানা গেছে, এই জেলাগুলোতে পানিতে আর্সেনিক তেমন ক্ষতিকর মাত্রায় নেই। ফলে এসব জেলার ফসল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম আর্সেনিকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে তাঁদের গবেষণায় জানা গেছে, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, লেড, আর্সেনিক, মার্কারি, নিকেল, সিলেনিয়াম, ক্লোরিন, বায়ো-কার্বোনেট, সালফেট, নাইট্রেট ইত্যাদি রাসায়নিক উপাদান বেশি থাকলে সে পানি পান করা যায় না। আবার ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ও ভাইরাসের অনুজীবের সংখ্যা বেশি থাকলে পানি ফুটিয়ে খেতে হয়।
এই গবেষণা দলের প্রধান বলেছেন, মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, সোডিয়াম, মার্কারি, ক্লোরিন, লেড পানিতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। আর পানিতে ভারী ধাতু থাকলে শস্য উত্পাদন কমে যায়। ওই সব ফসল খেলেও মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এ বিষয়ে ড. জাহেদুল ইসলামের ৪০টি গবেষণা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর অধীনে পানির নানা বিষয়ে মাস্টার্সের ১৫ জন ছাত্রছাত্রী থিসিস করেছেন। বর্তমানে পাঁচজন থিসিস ও একজন পিএইচডি করছেন। তাঁদেরই একজন নাসরিন জাহান ফসলের পোকামাকড় নিধনের জন্য ‘সিনথেটিক পেস্টিসাইড’ নামের উপাদানের ব্যবহারের ফলে পানি ও মাছের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর সহপাঠী আহসান হাবীব ‘অর্গানিক ফসফরাস পেস্টিসাইড কী মাত্রায় পানিতে থাকলে মাছ উত্পাদন ব্যাহত হবে না, সে বিষয়ে গবেষণায় রত। আর পানিতে ফেলা তামাকজাত পণ্যের বর্জ্যের রাসায়নিক উপাদান কেমন থাকে এবং শাকসবজির অঙ্কুরোদগমে তার প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন সাদ্দাম হোসেন।
আর্সেনিক ও পানি নিয়ে করা গবেষণাগুলোয় বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক ড. বলরাম রায়, কৃষি রসায়নের অধ্যাপক ড. বিকাশচন্দ্র সরকার, প্রভাষক সাজেদুর রহমান। গবেষণাগুলো চালিয়ে যেতে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ড. জাহেদুল ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন গবেষণাগারে তাঁরা নমুনা পরীক্ষা করেন। তবে তিনি জানান, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় গবেষণাগার তৈরি হয়ে গেলে এ সমস্যা আর থাকবে না। কাজটি প্রক্রিয়াধীন।