ভাসমান খুদে বিক্রেতাদের স্কুল
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
কেউ হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে, কেউ চকলেট, কেউ সিগারেট আবার কেউ ভিক্ষা করে। এদের বয়স ৪ থেকে ১২ বছর। বিকেল হলে সবাই জড়ো হয় এক জায়গায়। নামতা পড়া, ছড়া মুখস্থ করা, স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি শব্দসহ নানা কিছু শেখে। মাটিতে পুরোনো ব্যানার বিছিয়ে চলে এই ভাসমান খুদে বিক্রেতাদের স্কুল।
ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের পাশেই ব্যায়াম করার একটি জায়গা আছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি সাদা বোর্ড, একটি মার্কার ও পুরোনো একটি ব্যানার বিছিয়ে রাখা। ভেজা চুলে দৌড়ে এল রাতুল। মাত্রই লেক থেকে গোসল করে এসেছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নিজের নাম বাংলা ও ইংরেজিতে বানান করল। ‘আমি অহন অনেক কিছু পারি।’ বলেই রাতুল পড়ার জন্য ব্যানারের ওপর বসে পড়ল।
প্রতিদিন বিকেলে রাতুলরা এখানে পড়তে বসে। প্রজেক্ট আলোকিত শিশু নামের স্কুলটি ওদের পড়ায়। গর্ব বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের অন্যতম একটি প্রজেক্ট হচ্ছে আলোকিত শিশু। এর দায়িত্বে আছেন মিথুন দাস। চাকরির পাশাপাশি প্রতিদিন পড়াতে চলে আসেন। মিথুন শোনালেন এর শুরুর গল্প।
ধানমন্ডি লেকে গত বছর মিথুনের কাছে হাসান নামের এক শিশু এসে টাকা চায়। সারা দিন কিছু খায়নি জানায়। মিথুন বলেন, ‘তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, দুপুরে খাইনি, তাই আমারও ক্ষুধা ছিল। হাসানের সঙ্গে আরও দুজন ছিল। ওদের নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম।’ মিথুন খেতে খেতে ওদের গল্প শোনেন। কিছু একটা করার ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। তিনি তখন গর্ব বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতেন। সেখানে জানিয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবরে দু-তিনজন শিশুকে নিয়ে ধানমন্ডি লেকে পড়ানো শুরু করেন। এখন প্রায় ২৫টি শিশু।
সামনের সারিতে বসা আলেয়া এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। ও বলে, ‘স্কুলে অনেক মজা লাগে। মাঝেমইধ্যে খাইতে দেয়।’ গলা থেকে সিগারেট বিক্রির বাক্স এক পাশে রেখে মো. ফাহাদ পেছনের সারিতে বসল। ফাহাদের বাড়ি বরিশালে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এরপর পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসে। বউবাজারে থাকে। সারা দিন সিগারেট বিক্রি করে বিকেল হলেই পড়তে চলে আসে। ফাহাদ বলে, ‘পড়তে তো মন চায়। কিন্তু সংসারের লাইগ্যা লেকে সিগারেট বেচি। স্কুলের ভাইয়ারা কইছে, আমারে অন্য স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা কইরা দিব।’
স্কুলটি অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিক্ষার প্রাথমিক বিষয়গুলোই এখানে পড়ানো হয়। মিথুন বলেন, বাংলা দেখে পড়তে পারা, শুনে লেখা, নামতা ও গণিতের প্রাথমিক ধারণা এবং কিছু ইংরেজি শেখান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আদব-কায়দাও শেখানো হয়। বই, খাতা, কলম ও ব্যাগ স্কুল দেয়। মাঝেমধ্যে পড়ানো শেষে ওদের হালকা কিছু খাবারও দেওয়া হয়।
আগামী মাস থেকে হাতের কাজ (ক্র্যাফট) শেখানো শুরু করবেন। সবাইকেই যেহেতু সংসারে টাকা দিতে হয়, তাই হাতের কাজ শেখাবেন। যাতে বিভিন্ন জিনিস বানিয়ে বাইরে বিক্রি করে নিজেদের ভালো কোনো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
মিথুনের সঙ্গে আছে প্রায় ৩০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল। তবে সবাই নিয়মিত না। পালা করে তাঁরা সপ্তাহের বিভিন্ন দিন এসে মিথুনকে সাহায্য করেন। গতকাল মিথুনের সঙ্গে ছিলেন আতিকুর রহমান। প্রায় আট মাস ধরে কাজ করছেন।
গর্ব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নুহীন খান বলেন, ‘ওদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এদের মধ্যে কেউ ভালো করলে তাকে আমরা অন্য স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করব।’ তিনি আরও বলেন, ফাউন্ডেশনের সদস্যরা মিলেই এর খরচ বহন করছেন। তবে অনেকের কাছ থেকেও বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পান। জানালেন, মুন্সিগঞ্জে এর আরেকটি স্কুল আছে, যেখানে বেদে সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের পড়ানো হয়।
আলোকিত শিশু নামকরণ প্রসঙ্গে মিথুন বলেন, ‘আমরা পথশিশু বলি, এটা শুনলে ওদের মন খারাপ হয়। ওরা পথশিশু নয়, ওরা হবে সমাজের আলোকিত শিশু।’
লেকে বিকেল হলে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। পাশ দিয়ে যাঁরা যাচ্ছেন, অনেকেই আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। কেউ ছবি তুলছেন, উৎসাহও দিচ্ছেন। এদিকে মিথুন পড়াচ্ছেন, অন্যদিকে শিশুদের দুষ্টুমিও চলছে। একটু শাসন করে আবার শুরু করেন—‘এক ও একে এক।’