বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় : সবুজ শিক্ষা!
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে ১ হাজার ২০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। হাজার প্রজাতির গাছে ঘেরা এই প্রাঙ্গণে পা রেখেই পাবেন চোখ বুজে, বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার আনন্দ। আনন্দটা আরও বাড়বে, যদি আপনার জানা থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গত ৫৫ বছরে তৈরি করেছে ৪২ হাজারেরও বেশি কৃষিবিদ। দেশের কৃষি গবেষণায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। বর্তমানে এখানে পড়ছেন ছয় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
ক্যাম্পাসের পিচঢালা রাস্তা ধরে হেঁটে কিংবা রিকশায় এগোলে দুই পাশে শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির। খুব সকালে এই ‘আবহসংগীত’ স্বাগত জানায় শিক্ষার্থীদের। ক্লাস শুরু হয় সকাল আটটায়। চলে ঠিক সাড়ে চারটা পর্যন্ত। মাঝে দেড় ঘণ্টার বিরতি। পশুপালন অনুষদের ইন্টার্নি শিক্ষার্থী ওয়াহিদুজ্জামান মজা করে বলছিলেন, ‘আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে বলি কিন্ডারগার্টেন।’
একই অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আতিক হাসান বললেন, ‘তাত্ত্বিক পাঠদানের চেয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক ক্লাসকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। হাতে-কলমে শিখে কৃষিক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার প্রত্যয় নিয়েই এখানে ভর্তি হয়েছি। এখানে আমাদের হালচাষ থেকে শুরু করে কৃষির প্রতিটি কাজ নিজের হাতে করতে হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারটি দাঁড়িয়ে আছে একটা পরিণত গাছের মতো। যার ফল ভোগ করছে গোটা বাংলাদেশ। উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই সেন্টারটি ৯০টির বেশি ফলের জাত উদ্ভাবন করেছে। ১১ হাজার ফলের প্রজাতি নিয়ে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। এখানে হারিয়ে যাওয়া ফলের জাত সংরক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হয়।’
৫৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনের তালিকায় যোগ হয়েছে বহু সাফল্য। কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী অলিউজ্জামান জানালেন, ‘বাউকুল, ধান, সরিষা, সয়াবিন, আলু, মুখিকচুর বেশ কয়েকটি করে জাত উদ্ভাবন হয়েছে আমাদের এখানে। কলা ও আনারস উত্পাদনের উন্নত প্রযুক্তি, জৈব সার উৎপাদন প্রযুক্তি, মাটি পরীক্ষার সরঞ্জাম, গবাদিপশুর ভ্রূণ প্রতিস্থাপন, মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধিগাছের ব্যবহার ও হাওর এলাকায় হাঁস পালনের কলাকৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। তারাবাইম, গুচিবাইম, বড় বাইম, কুঁচিয়া ও বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। মাছ এবং সবজি সমন্বিত চাষ প্রযুক্তি, কচি গমের পাউডার উত্পাদন, নিরাপদ শুঁটকি তৈরির টানেল, বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার, গাভির ওলান প্রদাহ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি আবিষ্কার—এমন নানা ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়।’
ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষে ছাত্রীদের চারটি হল। বাকৃবির শিক্ষার্থী সিফাত রেজিয়া ও আরিফা জাহান থাকেন সুলতানা রাজিয়া হলে। সময় পেলেই ঘুরতে চলে যান নদের ওপারের চরে। বলছিলেন, ‘চরের মানুষের জীবনসংগ্রাম একটা অন্য রকম অনুভূতি দেয়।’ নৌকাভ্রমণও এখানকার শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস-জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাতে নৌকার পাটাতনে শুয়ে তারা ভরা আকাশের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ ছাড়েন না অনেকে। এ সময় কেউ গলা ছেড়ে গান ধরলে তো কথাই নেই!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আওতায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। জানালেন কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী রাউফুর লিমন। বলছিলেন, ‘ত্রিভুজ, পদচিহ্ন, অঙ্কুর, কম্পাস নাট্য সংগঠন, বিনোদন সংঘ, সাহিত্য সংঘ, সংগীত সংঘ, বিজ্ঞান সংঘ, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও ডিবেটিং ক্লাব সারা বছরই সক্রিয় থাকে।’ এ ছাড়া রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন, স্কাউট, বিএনসিসি ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনে নেতৃত্ব দিতে নিজেকে প্রস্তুত করছেন অনেকেই।
বছরের পর বছর ডাইনিংয়ে খাবারের মেনু বদল না হলেও, নিজেদের মতো করে হলজীবনে বৈচিত্র্য খুঁজে নেন বাকৃবির হলগুলোর বাসিন্দারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের শিক্ষার্থী খন্দকার তায়েফুর রহমান বলছিলেন, ‘হল একটা পরিবার। সবাই মিলে খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি কিংবা ফিস্ট করার মধ্যে অনাবিল আনন্দ আছে। হলের সামনে লেক বা পুকুরপাড়ে বসে সময় কাটানো একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা। তবে সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের মার্কেটগুলোতেই আমাদের বেশির ভাগ সময় কাটে।’
‘আমাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কৃষিবিষয়ক বইয়ের সংগ্রহশালা হিসেবে বাংলাদেশে প্রথম ও এশিয়ার সর্ববৃহৎ।’ দাবি করলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের শিক্ষার্থী আবদুল হাই। জানালেন, এখানকার কৃষি জাদুঘরে রয়েছে ৪০০-রও বেশি কৃষি উপকরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্স্য জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে ২৭০ প্রজাতির দেশীয় মাছ। গাছ ও ফসলের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে প্ল্যান্ট ডিজিজ ক্লিনিক। কৃষি শিক্ষার অনুষঙ্গ হিসেবে রয়েছে সমৃদ্ধ-সুবিশাল বোটানিক্যাল গার্ডেন।
এত কিছুর ভিড়েও শিক্ষার্থীদের যা সবচেয়ে বেশি টানে, তা হলো মায়া! শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেলেও তাই সুযোগ পেলেই পুরোনো ক্যাম্পাসে পা রাখেন সাবেক শিক্ষার্থীরা।
একটা সুখবর দিতে চাই
মো. আলী আকবর
উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
কৃষক, কৃষিবিদ ও গবেষকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমি কমেই চলেছে। তারপরও দেশে এখন কোনো খাদ্যঘাটতি নেই। ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত। আমাদের কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের সেভাবেই তৈরি করা হচ্ছে।
আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক দেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। দেশে আমরাই প্রথম খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই কৃষিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিচ্ছি। ‘স্বপ্ন নিয়ে’র মাধ্যমে একটা সুখবরও দিতে চাই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম নিরাপদ খাদ্যের (ফুড সেফটি) ওপর স্নাতক ডিগ্রি চালু হচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির আন্তরিকতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওর অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। একটি বায়োটেকনোলজি ও পরিবেশ বিজ্ঞানের ওপর আরও দুটি ইনস্টিটিউট চালু করার পরিকল্পনাও আছে।