প্রোগ্রামার বানানোর পাঠশালা
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
সময়টা গত বছরের ১৪ আগস্ট। চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে চট্টগ্রামেরই একদল তরুণ উদ্যোক্তার মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে আসে চট্টগ্রামের প্রথম প্রোগ্রামিং স্কুল ‘আউটসবুক প্রোগ্রামিং স্কুল’ গঠনের পরিকল্পনা। ‘থিংক আউটসাইড দ্য সার্কেল’ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে আউটসবুকের মাধ্যমে দেশের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ভালো মানের প্রোগ্রামার হিসেবে গড়ে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন আউটসবুকের মূল উদ্যোক্তা শাহীন মোহাম্মদ ফারুক। তিনি হাওলাদার সফটওয়্যার লিমিটেডে সিনিয়র সফটওয়্যার হিসেবে কর্মরত। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন আরো একদল কর্মী।
প্রোগ্রাম শেখার ইশকুল
‘আউটসবুক’ পরিচালিত বিদ্যালয়ে প্রোগ্রামিংয়ের পাঠ নিচ্ছে চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ২২ জানুয়ারি নগরীর মোমিন রোডে কদম মোবারক এম ওয়াই উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল সে রকমই এক চিত্র। প্রোগ্রামিংয়ের জটিল সব সমস্যা ও শব্দ সংকেতের খেলায় মত্ত একদল খুদে শিক্ষার্থী। ব্লাকবোর্ডজুড়ে ইংরেজি হরফের কিছু শব্দ ও সংকেত। হঠাৎ করে বুঝে ওঠা কঠিন। চলছে শিক্ষার্থীদের একের পর এক প্রশ্ন। সঙ্গে সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সমস্যার সমাধান। নিমিষের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা বুঝে যাচ্ছে প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা। এভাবেই স্কুল পড়ুয়াদের মধ্য থেকে প্রোগ্রামার বানানোর লক্ষ্যে কাজ করছে সংগঠনটি। বিনা মূল্যে সফটওয়্যার তৈরি থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিংয়ের সব কিছু শেখানো হয় পাঠশালায়। আউটসবুকের মূল উদ্যোক্তা শাহীন মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘স্কুল শিক্ষার্থীরাই একদিন বানাবে নতুন নতুন সফটওয়্যার ও গেম। একদিন তারা হবে পৃথিবীর সেরা প্রোগ্রামার, বয়ে আনবে সুনাম—এমন স্বপ্নই দেখি আমরা।’
প্রতি শুক্রবার
চট্টগ্রামের কদম মোবারক এম ওয়াই স্কুলে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মোট তিনটি শিফটে পরিচালিত হয়ে থাকে আউটসবুকের কার্যক্রম। ক্লাস শেষে আউটসবুকের মূল উদ্যোক্তা শাহীন মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে এ উদ্যোগের গোড়ার কথা। ‘২০০৯ সাল। আমি তখন বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের স্নাতকের ছাত্র। প্রোগ্রামিং সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ছিল না বলে পড়ার সময় বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। সে সময় প্রথম প্রোগ্রামিং নিয়ে একটি স্কুল করার কথা মাথায় আসে। বন্ধুদের নিয়ে পটিয়া, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ার গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রোগ্রামিং শেখানো শুরু করি। বছরখানেক চলার পর এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে হাল ছাড়িনি। স্নাতক শেষে একটি সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার পর আবার চেষ্টা করতে থাকি বিদ্যালয় চালুর। ২০১২ সালে আউটসবুক নাম দিয়ে একটি ওয়েবসাইট চালু করি। সাহায্যের হাত বাড়ায় পরিচিতজনরা। ভালো সাড়া পাওয়া যায়। মনের জোর আরো বেড়ে যায়। অবশেষে ২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট বড় পরিসরে এ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করি।’
তিনি আরো জানান, বর্তমানে আউটসবুকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ২৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। নিয়মিত চর্চা করার জন্য আউটসবুকের রয়েছে নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট। অনুশীলনের জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামিং সমস্যা দেওয়া আছে সাইটে। যাতে তারা খুব সহজেই তা বুঝতে পারে এবং সমাধানে আগ্রহ দেখায়। এতে করে গণিত ও ইংরেজিতেও তাদের দক্ষতা বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত চর্চা করছে। প্রতি মাসে সর্বাধিক সমস্যা সমাধানকারীর জন্য রয়েছে পুরস্কারের ব্যবস্থাও।
কেন এ উদ্যোগ
শাহীন মোহাম্মদ ফারুক জানান, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ সরকারিভাবেই প্রোগ্রামিং শেখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ও শেখাচ্ছে। আমাদের দেশে এর সুযোগ খুবই কম। যতটুকু আছে সেটা আবার ঢাকাকেন্দ্রিক। চট্টগ্রাম এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতেই আমাদের এ উদ্যোগ। আমাদের দেখে বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের স্কুল গড়ে উঠলে তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে যাব আমরা।’
প্রোগ্রামিং শিখতে আসা সুরাইয়া জাহানারা বলেন, ‘গত্বাঁধা পাঠ্য বইয়ের বাইরে গিয়ে কম্পিউটার সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায় এখানে। প্রোগ্রামিংয়ের নানা বিষয় খেলাচ্ছলে পড়ানো হয়। ফলে প্রোগ্রামিং আমার কাছে দারুণ মজার বিষয় হয়ে উঠেছে।’
সচেতনতার পাঠ
প্রোগ্রামিং শেখানোর পাশাপাশি স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো ও আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও ইভেন্টের আয়োজন করে থাকে ‘আউটসবুক’। গেল ২৯ জানুয়ারি অনলাইন প্রোগ্রামিং কনটেস্টের আয়োজন করে। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি আয়োজন করা হয় অনলাইন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অংশ নেয় এতে। গত বছর ১৩ নভেম্বর ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করে আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, যেখানে স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে ৪৩টি দল অংশ নেয়।
পেছনের মানুষ
প্রোগ্রামিং স্কুলের সঙ্গে যুক্ত আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হানিফ সিদ্দিকী, একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাশেদ মুস্তফা, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান ও বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রভাষক মিনহাজ হোসেন।
আরো আছেন দেবরাজ বড়ুয়া, আমজাদ হোসেন, হেলাল উদ্দিন, হাসনাইন আহমেদ শাকিল, নিজাম উদ্দিন, এ কে এম সাদি, মাহাবুব এ রাব্বি, পরাগ পাল, মোহাম্মদ রাসেল আহমেদ, মোহাম্মদ সাইফুল, আদনান, আশিক, সাকিব মাহমুদ, আরফাতুল ইসলাম ও সামিয়া সাফা আহমেদসহ অনেক স্বেচ্ছাসেবী। এ ছাড়াও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছেন আউটসবুকের সঙ্গে, যাঁরা নিয়মিতভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন।