ক্যাম্পাসের বিদেশি বন্ধু
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
অনেক বিদেশি ছেলেমেয়ে পড়েন মেডিক্যালে। তাঁদের একজন তানজিলা জহুর, অন্যজন বিবেক ঝা। কাশ্মীর আর নেপালের এই দুই ছাত্রছাত্রী পড়েন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে।
তানজিলা জহুর ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্রী। এইচএসসি পাস করেছেন ভারতের কাশ্মীরের শ্রীনগরের প্রেজেন্টেশন কনভার্ট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। ডাক্তার হওয়ার খুব ইচ্ছা তাঁর। ফলে মেডিক্যালে আবেদন করলেন। কাশ্মীরের কয়েকটি মেডিক্যালে সুযোগও হলো। তার পরও আরো ভালো মানের কোনো মেডিক্যালে ভর্তির জন্য আমাদের সরকারি মেডিক্যালগুলোতে সার্ক বৃত্তির মাধ্যমে কোটায় আবেদন করলেন। চান্স পেলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে। বিভাগীয় কৃষি কর্মকর্তা বাবার ইচ্ছা ছিল না—মেয়েকে এত দূরে লেখাপড়া করতে পাঠাবেন।
তবে মা মেয়েকে ভালো ডাক্তার বানাবেন বলে পণ করেছিলেন। ফলে শেষতক তানজিলা বাংলাদেশে আসতে পারলেন। এখানে আসার আগেই তিনি এক প্রতিবেশীর কাছে একটিমাত্র বাক্য শিখে নিয়েছিলেন। সেটিই কাজে লাগল ২০১২ সালে, বিমানবন্দরে নামার পরে। এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডেকে তানজিলা বললেন, ‘এই, মতিঝিল প্যাসিফিক হোটেলে যাবে? ভাড়া কত নেবে?’ ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে এলেন। কয়েক দিনের মধ্যে মেডিক্যালে ভর্তি হলেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে এ দেশে আসতে আসতে তিন মাস লেগে গিয়েছিল তাঁর। তবে ৪০তম ব্যাচের এই ছাত্রী বন্ধু আর শিক্ষকদের সাহায্যে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছেন।
তানজিলা থাকেন রুমানা পারভিন হলে। শুরুতে তিনিই ছিলেন এই মেডিক্যালের একমাত্র কাশ্মীরি ছাত্রী। এখন অবশ্য সংখ্যা আরো বেড়েছে। শুরুতে তারা পাঁচজন মিলে একটি ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে থাকতেন। একে তো বিদেশি ছাত্রী, তার ওপর এমন নানা হ্যাপা। ফলে পড়তে খুব অসুবিধা হতো। এখন অবশ্য এক রুমে তাঁরা দুজন থাকেন। আমাদের খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও তাঁর অসুবিধা হয়েছিল। কাশ্মীরে তাঁরা আমাদের মতো ভাত খান। তবে আমাদের দেশে এসেই তিনি প্রথম গরুর মাংস, চিংড়ি, তেহারি আর বোরহানি খেলেন। তাঁদের দেশে বোরহানি বলে কিছু নেই। এটি তাঁর খুব ভালো লেগেছে।
তানজিলা বললেন, ‘হোস্টেলের খাবারের মানও বেশ ভালো।’ তিনি প্রতিদিন শাকসবজি, ডিম, মাছ আর মুরগি খান। গল্প করতে করতে প্রথম দিনের ক্লাসের একটি ঘটনার কথা বলে হেসে ফেললেন তিনি, “সেদিন আমি এক ক্লাসমেটকে তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলেছিল ‘আমার নাম?’ তারপর থেকে আমি ওকে ‘আমার নাম’ বলে ডাকতাম আর সে হেসে ফেলত। পরে জানলাম এটি একটি প্রশ্ন, কারো নাম নয়।” হলে থাকায় বাংলা শেখায় তাঁর বেশ সুবিধা হয়েছে, বললেন তিনি। এখন তিনি বাংলায় বেশ পাকা, প্রতিদিনের শব্দগুলোও জানেন। ভাষার এই সমস্যায় তাঁর ক্লাসের পড়া বুঝতেও অসুবিধা হতো। শিক্ষকদের সাহায্যে সেটি কাটিয়ে উঠেছেন। ঘুরেছেন সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার আর রংপুরে। মার্কেটে গিয়ে কিনেছেন থ্রি-পিস আর শাড়ি। থ্রি-পিসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও শাড়ি তাঁর বেশ ভালো লাগে। কয়েকবার পরেছেনও। দুই ঈদের যেটিতে বেশি ছুটি পান, সেবার বাড়ি যান। আর প্রতিদিন তো মা-বাবা আর বড় বোনের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়ই। এমবিবিএস পরীক্ষা দিয়ে নিজ দেশে চলে যাবেন এই বিদেশি মেয়ে।
বিবেক ঝাও পড়েন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে। তিনি তানজিলার সহপাঠী। বাড়ি নেপালে। বাবা নেপালি, মা ভারতীয়। মা ভালো বাংলা বলেন। বিবেক মায়ের কথা বুঝলেও নিজে বাংলা বলতে পারতেন না। সেটি শিখলেন বাংলাদেশে এসে। মায়ের মুখের কথাই তাঁকে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান মডার্ন হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন বিবেক। তাঁর দেশে মেডিক্যালে সিট কম বলে বাংলাদেশে পড়ার আবেদন করেন। সরকারি বৃত্তিও পান। সে বছরের মে মাসে এখানে এসে বন্ধুর বড় ভাইয়ের কাছে ওঠেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হলে থাকেন। তিন দিন পর থেকে তাঁর ঠিকানা হলো সলিমুল্লাহ মেডিক্যালের প্রধান ছাত্রাবাস। এখনো সেখানেই আছেন। ভাষাগত সমস্যা তাঁরও ছিল প্রথমে। শিক্ষক আর বন্ধুরা সেটি কাটিয়ে উঠতে খুব সাহায্য করেছেন। শুরুতে এ দেশের খাবারগুলোর সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারতেন না। সেগুলোর নামও জানতেন না।
একদিনের ঘটনা বলে তো হেসে দিলেন বিবেক, ‘আমাদের হলের ক্যান্টিনে গিয়ে আমি ইংরেজিতে খাবারের অর্ডার দিলাম। ক্যান্টিনের ছোট্ট বেয়ারা তো ইংরেজি বোঝে না। সে অবাক হয়ে ফিরে গেল। পরে অন্যরা যা খাচ্ছে, সেগুলো দেখিয়ে আমিও খাব ইশারায় বললাম। এবার খাবার এলো।’ এরপর শিখে নিলেন এক বন্ধুর নাম। সৌরভকে বিবেক ডাকতেন ‘সরাব’, জলকে বলতেন ‘জোল’। প্রথমদিকে মায়ের জন্য খুব মন খারাপ করতেন। ভাইবার, ইমুতে দিনের পর দিন কথা হতো। এখনো ছুটিছাঁটায় মাকে দেখে আসেন। এ দেশে তিনি বেড়িয়েছেন অনেক জায়গায়। ভালো লেগেছে সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জের হাওর, সিলেট, কুষ্টিয়া, রংপুর আর পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। কোনো দিন ভুলতে পারবেন না কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত। তাঁর আরেকটি মজার স্মৃতি আছে গুলিস্তানে। তাঁরা সেখানে শার্ট কিনতে গিয়েছিলেন। দোকানদার এক হাজার টাকা দাম হাঁকালেন। তিনি দুম করে বলে দিলেন, ‘সাত-আট শ টাকায় দিতে পারবেন?’
বন্ধু পাশ থেকে চিমটি কেটে বলল, ‘কথা বলিস না।’ সে দাম বলল তিন শ। বিবেক তো অবাক—এত কম বলছে কেন? দোকানদার হবে না বলে দিল। বন্ধু বিবেককে বলল, ‘চিন্তা করিস না। আমরা বের হওয়া মাত্র ডেকে এই দামেই দেবে।’ ঠিকই তাই হলো। তারপর থেকে বিবেক জেনেছেন, কোনো শার্টের দাম হাজার টাকা হলে সেটি তিন শতেও পাওয়া যেতে পারে। নেপালে টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটি এখন শার্ট পরেন। মাঝেমধ্যে ‘পাঞ্জাবি’। কারণ অনেকেই বলেছেন, পাঞ্জাবি পরলে তাঁকে নাকি সুন্দর লাগে! এ দেশের বিয়ের অনুষ্ঠান তাঁর বেশ ভালো লেগেছে। পূজাও করেছেন কয়েকবার। অবসরে বাংলা গান শোনা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বা খেলায় মেতে ওঠা, পুরান ঢাকার বিরিয়ানির দোকানগুলোতে পেট পূজা করা ছেলেটি এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন। বললেন, ‘পরীক্ষা শেষ হলেই আমি দেশে চলে যাব। তবে এই স্মৃতিগুলো আমাকে অনেক দিন ঘুমাতে দেবে না।’