আকাশে রোদের হাসি মানেই তো ক্রিকেট!
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। মাঠে মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত হলেও খেলা ছাপিয়ে তাঁর কাছে ক্রিকেটের ‘স্পিরিট’টাই বড়। খেলতে খেলতে কীভাবে ‘অন্য মানুষ’ হয়ে উঠলেন, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন গত ৬ জুন। যুক্তরাজ্যের লর্ডসে ‘এমসিসি স্পিরিট অব ক্রিকেট কাউড্রে লেকচার’-এ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন তিনি।
আমি ছিলাম সাউথ ডানেডিনের এক কিশোর, যে শনিবার সকালের অপেক্ষায় বাঁচত। এমন একটা সকাল, যেদিন বৃষ্টি থাকবে না। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখব হাওয়া বইছে, আকাশে সূর্য হাসছে। যদি সাউথ ডানেডিনে কখনো একটা গ্রীষ্ম কাটিয়ে থাকেন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বেশির ভাগ সকাল আমাকে হতাশ করত। তবু, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন আমার খুব প্রিয় ছিল। কারণ আকাশে রোদের হাসি মানেই তো ক্রিকেট!
কী রোমাঞ্চকরই না ছিল সেই সব দিন। মাঠে দাঁড়িয়ে যশ, খ্যাতি, মানসিক চাপ, প্রতিপক্ষ দল—কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হতো না। ভাবনাজুড়ে থাকত শুধু খেলাটাই।
ভালো খেলতে না পারলে চুক্তি বাতিল হবে, খ্যাতি থাকবে না—এসব দুশ্চিন্তা চেপে ধরত না। যে সতীর্থের অধিনায়কত্ব কেড়ে নিয়ে আমাকে দেওয়া হলো, তাকে দলের সঙ্গে একীভূত করার চ্যালেঞ্জ ছিল না। সমালোচনা করার জন্য মিডিয়া ছিল না। ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে কোনো স্পিনারের ওপর চড়াও হওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে হতো না।
আমার বাবা স্টু, ওটাগো দলের হয়ে ৭৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলেন। তিনি ‘শুধু খেলতেন’ বললে ভুল হবে; বরং বলা উচিত, ‘তিনি বেড়াতেন।’ কারণ বাবা যতগুলো ম্যাচ খেলেছেন, প্রায় সমানসংখ্যকবার বেঞ্চে বসে থেকেছেন! ওটাগো তখন ছিল জেদি, অদম্য তরুণের দল। দলের প্রত্যেকে জানপ্রাণ দিয়ে খেলত। সে সময় তাদের পারিশ্রমিক বলতে ছিল খাবার আর পানীয়। আমার বাবা সেটাই ভীষণ উপভোগ করতেন। বাবা যখন তাঁর ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতার গল্প বলেন, সে গল্পে রান-উইকেট-গড়—এসব থাকে না; বরং বারবার উঠে আসে বন্ধুত্ব, পরস্পরের প্রতি আস্থার প্রসঙ্গ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লোকে আমাকে দুর্বিনীত, আক্রমণাত্মক, এমনকি অহংকারীও বলত। আমি সেটা উপভোগ করতাম। নিউজিল্যান্ড ওয়ানডে টিমের সঙ্গে যখন যাত্রা শুরু হলো, তখন জয় ছাড়া কিছুই ভাবতাম না। অসম্ভব প্রতিযোগিতাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলাম। যেকোনো মূল্যে শুধু জয়টাই চাইতাম। এখন পেছনে ফিরে তাকালে অনুতাপ হয়। সুযোগ পেলে, অতীতের কিছু ঘটনা হয়তো বদলে দিতাম। ক্রিকেটীয় চেতনায় বেড়ে ওঠাটা অনেকটা জীবনে বেড়ে ওঠার মতো।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। জনসমক্ষে ঘটনাটা বলতে গেলে আমি এখনো বিব্রত হই। ২০০৬ সাল, ল্যানকেস্টার পার্কে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলছিলাম আমরা। দ্বিতীয় ইনিংসে কুমার সাঙ্গাকারা দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেছিল। সাঙ্গাকারা যখন ১০০ ছুঁল, শ্রীলঙ্কা ততক্ষণে ৯টি উইকেট হারিয়েছে। অপর প্রান্তে থাকা মুরালিধরন রানটা পূর্ণ করেই সাঙ্গাকারাকে অভিনন্দন জানাতে পপিং ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। উইকেটকিপার হিসেবে বল তখন আমার হাতে। আমি বেল ফেলে দিয়ে আম্পায়ারের কাছে আবেদন করলাম, আম্পায়ারও এক আঙুল তুলে দিলেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা আমরা জিতেছিলাম।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, ঘটনাটা বিতর্ক আর কিছু তিক্ত অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কানরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেছিল, ‘আইনত এটা রানআউট। কিন্তু ক্রিকেটে তো “স্পিরিট অব গেম”টাই মুখ্য। আশা করছি, এমন ঘটনা আর হবে না। ক্রিকেটটা এভাবে খেলা হয় না।’ পেছনে ফিরে যেতে পারলে, মুরালিকে আমি আউট করতাম না। সেদিন খেলার নিয়ম আমরা মেনেছি, কিন্তু নীতিটা মানিনি।
সেই ঘটনার ১০ বছর পর, এত দিনে আমার ভাবনার জগৎ অনেকটা বদলেছে। আমি বিশ্বাস করি, আমি এখন অন্য মানুষ। কুমার সাঙ্গাকারা আজ এখানে আছে। সাঙ্গা, আমি তোমার খেলার একজন মুগ্ধ দর্শক। তুমি আমার বন্ধুদের একজন। এই সুযোগে সেদিনের ঘটনার জন্য আমি তোমার আর মুরালির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আজ বলব, কোন ঘটনাগুলো আমার এই পরিবর্তনের পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এবং এটা মেনে নেওয়া ভালো, আমার ক্যারিয়ারে এই পরিবর্তন আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আমি যখন আমার মুখোমুখি দাঁড়ালাম এবং নিজেকে প্রশ্ন করলাম, খেলাটা আমি কেন খেলি, ধীরে ধীরে ক্রিকেটের গুরুত্বটা বুঝতে পারলাম। খেলার প্রতি আমার ভালোবাসাটা ফিরে এল। প্রথমে ধীরে, তারপর পুরোদমে।
টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে আমার প্রথম ম্যাচটাই ছিল আত্মপরিবর্তনের প্রথম ধাপ। রস টেইলরের কাছ থেকে অধিনায়কত্ব কেড়ে নিয়ে আমাকে দেওয়া হলো। সিদ্ধান্তটা বিতর্কিত ছিল। জাতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। প্রয়াত মার্টিন ক্রো (নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার) তো এমনও ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন, প্রচণ্ড বিরক্তিতে তিনি নাকি নিউজিল্যান্ডের টিম ব্লেজারটা পুড়িয়ে ফেলেছেন। ভয়াবহ ব্যাপার!
২০১৩ সালের শুরুর দিকের কথা। কেপটাউনে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলব আমরা। ঝকঝকে একটা দিন, যদিও পিচে খানিকটা ঘাস চোখে পড়ছিল। টসে জিতলে ব্যাটিং না বোলিং নেব, সেই সিদ্ধান্তও আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হচ্ছিল। ঠিক হয়েছিল, কেপটাউনের টেবিল মাউন্টেনের ওপর যদি ‘টেবিল ক্লথ’-এর মতো মেঘের আস্তরণ দেখা যায়, তাহলে আমরা সাউথ আফ্রিকাকে ব্যাট করতে দেব। আকাশে আতিপাতি করে খুঁজে মেঘের ছিটেফোঁটাও দেখতে পেলাম না। ঝকঝকে নীল আকাশ। অতএব, টসে জিতে আমরাই ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম।
তারপর? ১৯ ওভার ২ বলের মাথায় ৪৫ রানে আমরা অলআউট হলাম। আকাশে মেঘ না থাকলেও সাউথ আফ্রিকার বোলার স্টেইন, মরকেল আর ফিল্যান্ডারের কল্যাণে আমাদের মুখে যথেষ্ট মেঘ জমেছিল। ২০৬৯টি টেস্টের ইতিহাসে দশম সর্বনিম্ন স্কোর। যদি ৪৫ রানে অলআউট হওয়া একটা ইনিংস আপনাকে নিজের সম্পর্কে নতুন করে না ভাবায়, তাহলে আর কোনো কিছুই ভাবাবে না!
সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর, আমার দরজায় কোচ মাইক হেসন কড়া নাড়লেন। কিছুক্ষণ পর যোগ দিলেন দলের ম্যানেজার মাইক স্যান্ডল ও সহকারী কোচ বব কার্টার। সেই আড্ডাটা আমার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এনে দিল। আমরা মন খুলে কথা বললাম। দল হিসেবে আমরা কেমন আর লোকে আমাদের কী ভাবে—এ নিয়ে কথা হলো। একটা বিষয়ে একমত হলাম, লোকে আমাদের উদ্ধত, আবেগী আর সমর্থকদের প্রতি উদাসীন হিসেবেই চেনে। সে সময় দলে নতুন আসা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হতো না। সিনিয়র ক্রিকেটারদের কর্তৃত্ব ফলানো ছিল রীতির অংশ।
সব মিলিয়ে আমরা একমত হলাম, ব্যক্তিগত এবং দলগতভাবে আমাদের কোনো ‘চরিত্র’ সমর্থকদের কাছে নেই। দলে কোনো প্রাণ নেই। বাইরে তর্জন-গর্জন থাকলেও ভেতরটা আসলে ফাঁপা।
সেই সন্ধ্যায়ই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজেদের বদলাতে হবে। বিনয়ী ও পরিশ্রমী হিসেবে ব্যক্তিগত ও দলীয় পরিচিতি পেতে হবে। দীর্ঘদিন যে সমর্থকদের কষ্ট দিয়েছি, তাঁদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। বিপক্ষ দলের শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে।