প্রবাসে ক্যাম্পাস জীবন
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
প্রিয় জন্মভূমি থেকে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করছি। পিএইচডি করছি জাপানের সায়তামা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বিশ্বব্যাপী। আমার গবেষণার বিষয়, ভূ-দুর্যোগ সম্পর্কিত গবেষণা কর্ম যেমন : ভূমি ধস। (এবড়-যধুধৎফং ড়ৎ উরংধংঃবৎ ৎবষধঃবফ ড়িৎশং ষরশব খধহফংষরফবং) সেই ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে দেশ ছেড়ে এসেছি। সূর্যোদয়ের দেশে আমার দিনলিপিতে আছে অনেক ভাললাগা, আছে কিছু ভোগান্তিও।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডিমেড ফ্রোজেন রুটি পাওয়া যায়। তা খেয়ে গোসল সেরে ল্যাবে চলে আসি। সাধারণত জাপানীজদের লাঞ্চ শুরু হয় সাড়ে বারোটা থেকে এবং ডিনার সন্ধ্যার পূর্বেই। কিন্তু আমি তো বাঙালী। অভ্যাসবশত একটু দেরিতে খাই। দুপুর এবং রাতের খাবার হিসেবে সাধারণত নিজের তৈরি করা বাঙালী খাবার খেয়ে থাকি। বাঙালী খাবার বিশেষ করে মাছ, মাংস এবং পছন্দসই আইটেম কাছের মুসলিম কমিউনিটির মসজিদ থেকে সংগ্রহ করি। ভোগান্তির কথা বলেছিলাম? এটা সত্যিই ভোগান্তি। কারণ, পছন্দসই বাঙালী খাবার যথেচ্ছ পাওয়া যায় না। তবে ইউনিভার্সিটিতে দুইটি ক্যাফেটেরিয়া থেকে দুপুরের এবং রাতের খাবার মাঝে-মাঝে সেরে ফেলি।
অফিস সময় বলতে সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় শেষ হয়। যদিও গবেষণার জন্য কোন ধরাবাধা সময় নেই। মাঝে মাঝে সকাল থেকে শুরু করে রাত দশটা বা বারটা পর্যন্ত ল্যাবে থাকতে হয়। অবশ্য তা নির্ভর করে কাজের উপর। কখনো কাজ করতে করতে এক ঘেয়েমি চলে আসলে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে গিয়ে পরিচিত বাঙালীদের সঙ্গে আড্ডা এবং কফি পান করে কিছুটা ক্লান্তি দূর করি।
জাপানে সাধারণত সপ্তাহে শনি ও রবিবার দুই দিন ছুটি থাকে। ছুটির দিনগুলোতে একটু দেরিতেই ঘুম থেকে উঠি। পরিচিত বাঙালীরা মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে যাই। জাপানের বেশিরভাগ স্থানই অসাধারণ এবং পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। অধিকাংশ জায়গাই পাহাড়বেষ্টিত এবং অতি মনোরম। যা প্রত্যেক দর্শনার্থীর মন কেড়ে নেবে। আবার কখনও কখনও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কোন না কোন পরিচিত বাঙালীর বাসায় নিমন্ত্রণ থাকে এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে আড্ডা।
আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের পৃথক ছাত্রাবাস। সায়তামা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী ছাড়াও শ্রীলঙ্কান, পাকিস্তানী, বার্মিজ, নেপালী, ইন্ডিয়ান, মালয়েশিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, চাইনিজ, ইউরোপিয়ান এবং আমেরিকানরা পড়তে আসে। সব বিদেশী শিক্ষার্থীই এই ছাত্রাবাসে থাকে। সায়তামা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এখানে এক বছর করে থাকতে পারে। পরবর্তীতে তাদের বাইরে বাসা ভাড়া নিতে হয় এবং পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরের বাসায় থেকে চালিয়ে যেতে হয়।
জাপানের আবহাওয়া খুবই চমৎকার। সায়তামারটা মনে হয় বেশিই চমৎকার। কারণ, এখানে ঠা-া ও গরমের তীব্রতা অনেক কম। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি এবং অফিস-আদালত সবকিছু নিট এ্যান্ড ক্লিন। কারণ, জাপানীজরা ময়লা-আবর্জনা ফেলার ব্যাপারে খুবই সচেতন। এরা কখনও যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে না। তারা বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা বিভিন্ন পাত্রে সংরক্ষণ করে এবং রি-সাইকেল এবং রি-ইউজ করে। কোন কিছুই এদের কাছে ফেলনা নয়।
উন্নত দেশের গবেষণাগারগুলো সাধারণত অনেক উন্নত হয়ে থাকে। সুতরাং গবেষণা করতে এখানে কোন প্রকার বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। তবে অধিকাংশ বই-পুস্তক, যন্ত্রপাতি এবং সফটওয়ারসমূহ জাপানীজ ভাষায় হওয়ায় কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। জাপানীজ ভাষাটাকে রপ্ত করতে পারলে সব কিছু আবার সহজ হয়ে যায়। অবশ্য এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। সহপাঠী এবং শিক্ষকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্তরিক। জাপানীজরা দৈনন্দিন জীবনে ইংরেজী ভাষা কম ব্যবহার করাতে সহপাঠী এবং অন্যান্য অফিস ও শপিংমলগুলোতে ভাষাগত কিছু সমস্যা হয়ে থাকে।
জাপানীজরা নিয়ম মাফিক করে থাকে। সব কিছুতেই রয়েছে এদের সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সততা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কারও কোন সমস্যা হয় না। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কিছু করে টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে গবেষণার ব্যস্ততার কারণে আমার সেটা করা হয় না। আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের যৌথ অনুষ্ঠানে আমরা বাঙালীরা বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ঈদ উৎসব ইত্যাদি পালন করি বেশ ঘটা করেই।
প্রায় ৪০ জনের অধিক বাংলাদেশী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। অধিকাংশই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। বাংলাদেশীরা গবেষণায় অধিক মনোযোগী এবং পরিশ্রমী। সবাই এখানে মেধা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছে এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রী এবং জাপানীজদের কাছে বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।