এশিয়া ফাউন্ডেশন ডেভেলপমেন্ট ফেলোশিপ
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
উড়ে যাচ্ছিলাম মেকং নদীর ওপর দিয়ে, নিচেই সমৃদ্ধ মেকং বদ্বীপ। পানিসম্পদ প্রকৌশল নিয়ে পড়ালেখা আর কাজের সুবাদে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে মেকংয়ের কথা অনেক পড়েছি। এমনকি বুয়েটে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) আমার স্নাতক পর্যায়ের থিসিসের কাজটি ছিল মেকংয়ের ওপর করা একটি গবেষণার আলোকেই। যেই মেকং নিয়ে এত দিনের এত পড়ালেখা, আজ তার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল, ভাবতেই অদ্ভুত ভালো লাগছিল!
মেকংয়ের ওপর দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম আসলে ভিয়েতনামের কান্থো শহরে। হোচিমিন শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। এশিয়ার অন্যতম জলবায়ু সংবেদনশীল শহর হিসেবে কান্থো। সেখানে যাচ্ছিলাম জলবায়ু পরিবর্তনের নানা নেতিবাচক প্রভাবের মুখে শহরের উন্নয়ন ও নগরায়ণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে। পরের গন্তব্য হ্যানয়।
১৯৯০ সালেও বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের একটি ছিল ভিয়েতনাম। কীভাবে তারা ঘুরে দাঁড়াল, তাদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের প্রেক্ষাপটটিই বা কেমন, এসব প্রসঙ্গে নানা রকম কর্মশালার সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে এই সফর। সফরসঙ্গী এশিয়ার অন্য ১১টি দেশ থেকে আসা ১১ জন উদীয়মান তরুণ। তাঁদের কেউ মঙ্গোলিয়ায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন, কেউ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন, কেউবা নেপালের গ্রামে গ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ২০১৪ সাল থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সম্ভাবনাময় তরুণদের নিয়ে আয়োজন করে ‘এশিয়া ফাউন্ডেশন ডেভেলপমেন্ট ফেলোশিপ’, যার মূল লক্ষ্য এশিয়ার ভবিষ্যতের নেতৃত্বকে খুঁজে বের করা এবং তাদের একটি ‘প্রফেশনাল নেটওয়ার্কে’ জুড়ে দেওয়া। এশিয়া ফাউন্ডেশন ডেভেলপমেন্ট ফেলোশিপের অংশ হিসেবেই এপ্রিলের ৯ থেকে ২২ তারিখ ছিলাম কোরিয়া ও ভিয়েতনামে।
২০১৭ সালে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৯০০ আবেদন জমা পড়েছিল। ২ মাসব্যাপী বাছাইপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খুঁজে বের করা হয় ১২ দেশের ১২ জন সম্ভাবনাময় তরুণকে। এ বছরের ফেলোশিপে ছিল বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের প্রতিনিধি। ডেভেলপমেন্ট ফেলোদের নেতৃত্ববিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে এক সপ্তাহের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। সেখানে কোরিয়ান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের (কেডিয়াই) সহায়তায় গঠনমূলক নেতৃত্ব, আত্মোন্নয়ন, দ্বন্দ্ব সমাধান এবং কোরিয়ার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
কোরিয়ায় প্রশিক্ষণের তৃতীয় দিনই জানতে পারলাম মঙ্গোলিয়া থেকে আসা ফেলো, লাগভা এরদেনের প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এ বছর পুলিৎজার পেয়েছে। এমন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছি ভেবেও খুব গর্ববোধ হচ্ছিল। দুই দিন পরই জানতে পারলাম নেপাল থেকে আসা সুরিয়া কার্কি এ বছরের ফোর্বস এশিয়ার ‘ত্রিশ অনূর্ধ্ব সেরা ত্রিশে’ স্থান করে নিয়েছেন। আরও একটা চমৎকার খবর! বুঝতে পারলাম, এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও কাজপাগল মানুষ।
যদিও আমাদের ১২ জনের দক্ষতা ও কাজ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে, তবুও খুব সাবলীলভাবে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল প্রথম দু-তিন দিনেই। শান্তি-দ্বন্দ্ব, নেতৃত্ব-অনুসরণ, সমস্যা-সম্ভাবনা-সমাধান নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমেই অদ্ভুত এক হৃদ্যতা তৈরি হলো। ফেলোশিপের অংশ হিসেবেই ঘুরে এলাম স্যামসাং ইনোভেশন মিউজিয়াম। দেখে এলাম, কোরিয়ান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিকল্পনায় কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের গল্প রচনা হয়। পরিচিত হলাম কেডিআইয়ে অধ্যয়নরত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, ইউহা উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে এশিয়ান কালচারাল ফোরামে অংশও নেওয়া হলো।
এপ্রিলের ১৬ তারিখে সিউল থেকে চলে এলাম ভিয়েতনামের কান্থোতে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জানলাম জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। দেখা হলো এশিয়া ফাউন্ডেশনের টেলন-লাডলো শিক্ষাবৃত্তির আওতায় কান্থো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ভিয়েতনামের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসা মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিবিদ্যায় পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেয় এই বৃত্তি।
হ্যানয়ে গিয়ে ভিয়েতনামের উন্নয়নের প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা নিয়ে আমরা তিন দিনের কর্মশালায় অংশ নিলাম। এ ছাড়া ছিল ‘জেন্ডার’ প্রসঙ্গে দিনব্যাপী কর্মশালা। এশিয়া ফাউন্ডেশনের ওয়াশিংটন ডিসি কার্যালয় থেকে আসা দুজন প্রশিক্ষক খুব চমৎকার একটি প্রশিক্ষণ সেশনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লিঙ্গবৈষম্যের ধরন এবং এর ব্যাপারে করণীয়। এ বছর ভিয়েতনামে আয়োজিত হলেও ফেলোশিপের এই অংশটি প্রতিবছর এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন দেশে আয়োজিত হয়। এর আগে মঙ্গোলিয়া, ফিলিপিনস এবং নেপালে এই আসর বসেছিল।
ফেলোশিপ প্রোগ্রামে আমাকে বাছাই করা হয়েছে জলবায়ু ও পানি বিষয়ে আমার কাজ, বিতর্ক এবং একই সঙ্গে আমার টিভি শো ‘প্রজন্ম আগামী’র কাজকে বিবেচনা করে। আমার আগেও ২০১৬ এবং ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে দুজন এই ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হন। ‘নেতৃত্ব’-বিষয়ক এই প্রশিক্ষণের বাইরেও প্রত্যেক ফেলো নিজের ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার সমমানের বৃত্তি পান, যা প্রত্যেক ফেলো কোনো প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে লাগাতে পারবেন। এ বছরেরই সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত হবে এই ফেলোশিপের দ্বিতীয় ও শেষ অধ্যায়। সেখানেও আমরা বিভিন্ন সভা, কর্মশালা ও প্রশিক্ষণে অংশ নেব।