আনন্দ উৎসবে শিশুদের একদিন
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
মিলনায়তন ভর্তি এত্ত মানুষ! সামনের সারিতেই বসে আছেন মোটা মোটা চশমা পড়া স্যারেরা। পেছনের দিকে অভিভাবকরা। সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব আর চেনা-অচেনা শত শত শিশু-কিশোরেরাও আছে অবশ্য। এদের সামনেই উপস্থাপন করতে হবে নিজের ব্যবসায়িক ধারনা। ছোট্ট কিশোরী সোহা ফারহিন কী একটু নার্ভাস? ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মঞ্চে। তারপর মাক্রোফোন হাতে তুলে নিয়ে যখন বলা শুরু করলো নিজের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তখন যেন এক নিমেষেই উধাও হয়ে গেল সমস্ত ভয় ডর। বিচারক আর মিলনায়তন ভর্তি দর্শকদের মুর্হুমুহু করতালি দেখে সোহা বুঝে গেল সে চমৎকারভাবেই উপস্থাপন করতে পেরেছে নিজের ব্যবসায়িক ধারনা। কিন্তু পুরষ্কার কি মিলবে? সেজন্য সোহাকে অবশ্য অপেক্ষা করতে হলো বিকেল পর্যন্ত।
গতকাল শনিবার (১২ আগস্ট) সারাদিন এরকম নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে নাবিলার মতো কয়েক শ শিশু-কিশোর। কেউ এসেছিল উত্তরা থেকে, কেউ গাজিপুর থেকে, কেউ কেরাণীগঞ্জ থেকে। রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে মা-বাবার সঙ্গে তারা এসে জড়ো হয়েছিল ধানমন্ডির সোবহানবাগে অবস্থিত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সুবিশাল অডিটোরিয়াম ৭১ মিলনায়তনে। সারাদিন তারা হেসেছে, খেলেছে, গল্প করেছে আর ফাঁকে ফাঁকে অংশ নিয়েছে আইসিটি কুইজ, লোগো প্রতিযোগিতা, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, লেগো প্রতিযোগিতা, কিডস এন্টারপ্রেনার—এরকম নানা প্রতিযোগিতায়। তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘মাই ই কিডস’এর আয়োজনে ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সহযোগিতায় আয়োজিত ‘তৃতীয় মাই ই-কিডস ক্যাম্প ২০১৭’-তে অংশ নিয়েছিল এই শিশু-কিশোরেরা।
কেমন লাগছে মাই ই-কিডস ক্যাম্পে এসে? এমন প্রশ্নের জবাবে চতুর্থ শ্রেণি পড়–য়া জর্জ একগাল হেসে বলে, ‘দারুণ! এর আগে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এত আনন্দ পাইনি।’
কথা হয় জর্জের বাবার সঙ্গে। রাজধানীর মণিপুরী পাড়া থেকে আসা এই অভিভাবক জানান, জর্জ পড়ছে বিএসিএইচএ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ছেলেকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিজের সঙ্গে যুক্ত করতে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করাতেই এই ক্যাম্পে নিয়ে এসেছেন। তিনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে মাই ই-কিডস ক্যাম্পের খবর পান বলে জানান।
জর্জের মতো রাজধানীর সানিডেল স্কুল, সাউথব্রিজ স্কুল, ম্যাপললিফ স্কুল, সানবিমস স্কুল, মোহাম্মদপুর বয়েজ স্কুল, ধানমন্ডি বয়েজ স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন এই ক্যাম্পে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের উদ্যোগ সত্যিই অভাবনীয় বলে মন্তব্য করেন কেরাণীগঞ্জ থেকে আসা অভিভাবক শামসুন নাহার। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে পড়ছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ডানমন্ডি শাখায়। আরেক অভিভাবক উত্তম বণিক বলেন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষকরা অত্যন্ত যতœবান। তাঁরা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তানের মতো যতœ করেন।
কথা হয় উত্তম বণিকের মেয়ে বিথি বণিকের সঙ্গে। ‘আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। আগে অন্য স্কুলে পড়তাম, কিন্তু এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাসের পড়ার বাইরে কম্পিউটারের অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।’ বলছিল বিথি বণিক।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের উত্তরা শাখায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে জেনিফার প্রিয়ন্তী। সে জানায়, পড়াশোনার অবসরে কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতে ভালো লাগে তার। ইতিমধ্যে সি প্লাস ল্যাঙ্গুয়েজেরে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে সে। প্রিয়ন্তীর বন্ধু রাইসা তাবাসসুম জানায়, গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ে আগ্রহ তার। তাই অবসর সময়ে কম্পিউটারে গ্রাফিক্স শেখে সে।
প্রিয়ন্তী-রাইসার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল এসব বিষয় নিয়ে তখন একটু দুরে খানিক চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখা গেল নাবিলা আলীকে। তার কাছে গিয়ে ‘দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব?’ বলতেই এক গাল হেসে ফেলে নাবিলা। ‘বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি তো! পুরষ্কার পবো কি না বুঝতে পারছি না।’ বলছিল সাউথ ব্রিজ স্কুল থেকে আসা নাবিলা।
নাবিলাকে অবশ্য খুব বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তা পোহাতে হয়নি। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। মঞ্চে উঠেছেন মাই ই- কিডস্ ক্যাম্প-২০১৭ এর আহ্বায়ক রাহিমা কে মির্জা রোজমেরী। তিনি একে একে ঘোষণা করতে থাকেন পুরষ্কার বিজয়ীদের নাম আর বুক দুরু দুরু করতে থাকে নাবিলার বুক। অবশেষে শুনতে পায় নিজের নাম। দুইটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে টেকনো কিডস হয়েছে নাবিলা আলী। সে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে একটি নোটপ্যাড।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় অবশ্য অরেকজনের। শুরুতে যার কথা বলা হচ্ছিল সেই সোহা ফারহিনের। সে হয়েছে এই ক্যাম্পের শ্রেষ্ঠ বিজয়ী সুপারকিড। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে একটি ল্যাপটপ।
সকালে দিনব্যাপী এই ক্যাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতি ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল পরিবার ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইএমকে সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম কে আরেফ। অনুষ্ঠানে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আকিব খান।
বিকেলে সমাপনী ও পুরস্কারবিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ, কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল, সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফী, এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন, চ্যানেল-৭১ (একাত্তর টিভি) এর বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, স্বপ্নযাত্রার প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুপন রায়। দেশের তরুণদের কাছে জনপ্রিয় উদীয়মান তারকাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ওসামা বিন নূর, সালমান মুক্তাদির, রিজওয়ান খান ও শফিউল আলম।
আয়োজকরা জানান, মাই ই-কিডস একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সেন্টার, যেখানে ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স ভেদে ৫টি লেভেলে এক বছর মেয়াদী ‘এমএস কম্পিউটার’অ্যাপ্লিকেশন এবং প্রোগ্রামিং শেখনো হয়। বাংলাদেশে মাই ই-কিডসই প্রথম প্রতিষ্ঠান যেখানে শিশু-কিশোরদের বয়স ও চাহিদা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক কারিকুলাম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়ে থাকে।