করোনার বন্ধে যেভাবে পড়ালেখা করবে শিক্ষার্থীরা
- মনির আহমেদ
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বাসায় অনেক দিন ধরে অবস্থান করছে। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে এই ছুটি হয়তো আরও দীর্ঘ হতে পারে। এ সময় শিক্ষার্থীরা বাসায় থাকতে থাকতে অনেকটা একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছে।
অনেক শিশু বিরক্ত বোধ করছে, বাবা-মাকেও বিরক্ত করছে। বাইরে বেরোনো মানা থাকলেও বাইরে বেরোনোর জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক এই দীর্ঘ বন্ধের জন্য অনেকটা উদ্বিগ্ন তাঁদের সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে। হয়তো তাঁরা ভাবছেন দীর্ঘদিন বদ্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। হয়তো নিয়মিত ক্লাস না পাওয়ায় অনেকে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসে ব্যত্যয় হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের দৈনিক পাঠভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটছে। কিন্তু দেশের স্বার্থে, দেশের ছাত্রছাত্রীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নেওয়া প্রতিষ্ঠান বন্ধের এই পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন দিতেই হবে। তবে এ সময়ে শিক্ষার্থীরা যাতে লেখাপড়ায় পিছিয়ে না পড়ে, বিশেষত মাধ্যমিক শাখার আসন্ন অর্ধবার্ষিক বা প্রাক্-নির্বাচনী পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি না পড়ে, তার জন্য নিচে কিছু পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। প্রস্তাবিত এসব পদক্ষেপ আশা করি শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বসে পড়ালেখার কাজটি অব্যাহত রাখবে। আশা করি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
স্কুল রুটিন অনুযায়ী বাড়িতে পড়া তৈরি করা
স্কুল খোলা থাকলে শিক্ষার্থীদের খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি হয়। বন্ধের দিন এই অভ্যাসে ছেদ পড়ে। এই দীর্ঘ ছুটিতে যেন শিক্ষার্থীরা স্কুলের সময় অনুযায়ী ঘুম থেকে ওঠে। দাঁত মেজে, হাত–মুখ ভালোভাবে ধুয়ে নাশতা সেরে ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী পড়তে বসে। ক্লাস রুটিনে যেমন বিভিন্ন বার ও সময় অনুযায়ী ক্লাস হয়, শিক্ষার্থীরা সেভাবে প্রতিদিনের রুটিন সামনে নিয়ে পড়তে বসবে এবং পড়া প্রস্তুত করবে। রুটিনে টিফিনের সময় অনুযায়ী বাসায় হালকা নাশতা করবে, আবার পড়তে বসবে এবং ছুটির সময় অনুযায়ী পড়া থেকে উঠবে। ক্লাসে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটে, অবসরে দুষ্টুমি করে বলে হয়তো স্কুলে ৪-৫ ঘণ্টা সময় কাটানো উপলব্ধি করতে পারে না। বাসায় এত সময় একটানা পড়া কষ্টকর বিধায় বাসায় এই সময়ে পড়ার ফাঁকে একটু উঠতে পারে, অন্য রুমে যেতে পারে। এই সময়ে মা–বাবার মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে পড়ার বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে কিংবা খানিক সময়ের জন্য দুষ্টুমি করলেও অভিভাবকেরা তাদের ধমক না দিয়ে বুঝিয়ে আবার পাঠে মনোযোগী হতে বলতে পারেন।
শিক্ষককের সঙ্গে অনলাইন গ্রুপ
শিক্ষার্থীদের নিজেদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের আইডি ব্যবহার করে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অনলাইন গ্রুপ করে পড়াশোনা করতে পারে। পড়ার কোনো একটি বিষয় নিয়ে কিংবা কোনো সমস্যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারে। আজকাল বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনায় পড়ালেখার বিষয়বস্তু প্রায়ই থাকে না বলতেই নয়। দীর্ঘ এ ছুটিতে তাদের আলোচনায় বিজ্ঞানের নতুন কোনো আবিষ্কার বা গবেষণা, দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, সৌরজগতের নতুন কোনো গ্রহ কিংবা ধর্মীয় কোনো কাজ নিয়ে আলোচনা যুক্ত করতে পারে। বন্ধুদের নিজেদের গ্রুপের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যুক্ত করে বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার ওপর আলোচনা করা যেতে পারে। শিক্ষক নিজের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর অনলাইন ক্লাস নিতে পারে। এতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়ে ক্লাসের মতো প্রশ্ন করতে পারে, শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন দেখে উত্তর দেবেন, এমনকি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আলোচ্য বিষয়বস্তুর ওপর ফিডব্যাক নিতে পারেন।
শিক্ষক কর্তৃক ডিজিটাল কনেটেন্ট তৈরি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকই ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তা ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের অনেক শিক্ষক নিজেরাই ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে পারেন কিংবা অনেক অগ্রসর শিক্ষক নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে ক্লাসে পাঠদান করে থাকেন। সেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা ক্লাসে পাঠদানকৃত বিষয়ের ওপর ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপে প্রকাশ করতে পারেন কিংবা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন। এতে নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরেও অনেক শিক্ষার্থী প্রকাশিত কনটেন্ট দেখে উপকৃত হতে পারে। বিভিন্ন ফরমেটে এই কনটেন্ট তৈরি করা যেতে পারে। যেমন ওয়ার্ডে তৈরি করে পিডিএফ ফরমেটে রূপান্তর করতে পারেন, পাওয়ার পয়েন্টে স্লাইড তৈরি করতে পারেন কিংবা ভিডিও চিত্র তৈরি করে করতে পারেন। ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ জানা থাকলে ভিডিও, ইমেজ এবং পাওয়ার পয়েন্টের সমন্বয়ে শিক্ষক নিজের মাইক্রোফোনের মাধ্যমে অডিও যুক্ত করে কনটেন্টটিকে আরও আকর্ষণীয়ভাবে তৈরি ও উপস্থাপন করতে পারেন। ইতিমধ্যে অবশ্য অনেক প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে নিজেদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শেয়ার করার ব্যবস্থা করছে।
শিক্ষামূলক ওয়েবপোর্টাল ভিজিট করা
শিক্ষামূলক বিভিন্ন ওয়েবপোর্টাল রয়েছে যেখানে শ্রেণিভিত্তিক কিংবা বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন কনটেন্ট রয়েছে, যা থেকে শিক্ষার্থীরা সহজেই উপকৃত হতে পারে। বিশেষ করে https://www.teachers.gov.bd নামের সরকারি ওয়েবপোর্টালটির কথা উল্লেখ করা যায়। পোর্টালটিতে শিশু থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের সর্বশেষ ২ লাখ ৫৩ হাজার ৮২০টি কনটেন্ট রয়েছে। এগুলোর প্রায় এক হাজারের মতো কনটেন্ট বিভিন্ন সময়ে গুণগত মানের বিচারে মডেল কনটেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এসব কনটেন্টের মধ্যে অধিকাংশই পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডের মাধ্যমে তৈরি করা। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিক্ষক বর্তমানে এই পোর্টালের নিবন্ধিত সদস্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে এবং এটুআই (a2i) প্রোগ্রামের অধীনে আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এ পোর্টালটি তৈরি করা হয়। ডিজিটাল কনটেন্টে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এবং শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা, শিক্ষার পরিবেশ আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজে ইতিমধ্যে এই পোর্টালটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
এ ছাড়া কিশোর বাতায়ন নামে আরেকটি শিক্ষামূলক পোর্টাল রয়েছে, যা শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে, যার ঠিকানা হচ্ছে http://konnect.edu.bd/ এটিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে এবং এটুআই প্রোগ্রামের অধীনে আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে এবং UNDPসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এ পোর্টালটি তৈরি করা হয়। এতে শিশু-কিশোরদের উপযোগী বিভিন্ন মজাদার আকর্ষণীয় কনটেন্ট রয়েছে। যেমন বিভিন্ন গল্প, কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, শাহানা কার্টুন, মিনা কার্টুন, বিভিন্ন বিখ্যাত শিশুতোষ বা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র, কমিকস, হাতে আঁকা ছবি, নিজের তোলা ছবি প্রভৃতি রয়েছে এই সাইটটিতে। দৈনন্দিন জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহার, বয়ঃসন্ধিকাল বা কিশোর বয়সের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা ও তার প্রতিকার, মানসিক চাপ, আত্মসচেনতা ও শিশু সুরক্ষা সম্পর্কিত, সাম্প্রতিক সময়ের বিবিধ বিষয়াবলির ওপর লেখা রয়েছে। দেশের প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিশু-কিশোর এই কিশোর বাতায়নের সদস্য। এখন পর্যন্ত এতে ২ হাজার ১৬৯টি হাতে আঁকা ছবি, ২ হাজার ৯৪টি ক্যামেরায় তোলায় ছবি, শিশু–কিশোরদেরও লেখা ১ হাজার ৩৪৯টি গল্প, ১৮৭টি শর্টফিল্ম রয়েছে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই দীর্ঘ বন্ধে এই পোর্টালটি নিয়মিত ব্যবহার করে অনেক কিছু শিখতে পারে এবং তাদের অবসর সময় কাটাতে পারে।
সংসদ টেলিভিশনে আমার ঘর আমার স্কুল
চলমান সংকট মোকাবিলার অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ বন্ধ থাকায় পাঠদানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতির কথা ভেবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উদ্যোগে ২৯ মার্চ থেকে সংসদ টেলিভিশনে শুরু হয়েছে আমার ঘর আমার স্কুল নামে দূরশিক্ষণ প্রোগ্রাম। পরীক্ষামূলকভাবে প্রচারিত এই প্রোগ্রামে বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ২০ মিনিট করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মোট ৩ ঘণ্টা এই ক্লাস নিয়ে থাকেন। অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে প্রতিদিনের ক্লাসগুলো একই দিন বেলা ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত পুনঃপ্রচার করা হয়। কেউ ক্লাস না দেখতে পারলেও তাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কারণ এযাবৎ প্রচারিত সবগুলো ক্লাস কিশোর বাতায়নে দেওয়া আছে। শিক্ষার্থীরা যখন ইচ্ছা অনলাইনে দেখতে পারবে কিংবা চাইলে ডাউনলোড করে পরেও নিজেদের সুবিধামতো সময়ে দেখতে পারবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে পূর্ব থেকে ক্লাসের সময়সূচি প্রকাশ করে থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয় ও তারিখ অনুযায়ী পৃথক খাতা তৈরি করে নির্দেশিত বাড়ির কাজ সম্পন্ন করার জন্য এবং স্কুল খোলার পর সংশ্লিষ্ট শ্রেণিশিক্ষকের নিকট জমা দেওয়ার জন্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এই বাড়ির কাজের ওপর প্রাপ্ত নম্বর ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। ক্লাসের সময়সূচি মাউশির ওয়েবসাইটে (www.dshe.gov.bd) পাওয়া যাবে। দীর্ঘ স্কুল বন্ধে ছাত্রছাত্রীরা অধিদপ্তরের সময়সূচি অনুযায়ী বাড়িতে নিয়মিত সংসদ টিভির ক্লাস করে স্কুল বন্ধের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবে।
*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বিএএফ শাহীন কলেজ তেজগাঁও।
সূত্র: প্রথম আলো